অরণ্যশহরের তরুণ ব্যবসায়ী সৌরভ অগ্রবাল ওরফে রকিকে অপহরণ করে খুনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ঠিকাদার অশোক শর্মাকে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ বার অপহরণের সময় ব্যবহৃত গাড়ি এবং বিদেশি পিস্তল বাজেয়াপ্ত করল পুলিশ। ঝাড়গ্রাম শহরের স্টেট ব্যাঙ্কের কাছে অশোকের পেল্লায় বাড়ি, সেখানে তল্লাশি চালিয়েই পাওয়া গিয়েছে বিদেশি পিস্তল। ওই বাড়ির গ্যারাজ থেকেই উদ্ধার হয়েছে অপহরণে ব্যবহৃত চকোলেট রঙের গাড়িটি। ওই গাড়ি অশোকের বলেই পুলিশ জানিয়েছে।
ঝাড়গ্রাম শহরের ইমারতি সরঞ্জামের ব্যবসায়ী রকি গত ২৫ এপ্রিল নিখোঁজ হন। ৮ মে অশোক-সহ তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বাকি দুই অভিযুক্ত হলেন অশোকের ভাইপো সুমিত শর্মা ও অশোকের পরিচারক টোটন রাণা। কিন্তু তার আগেই অবশ্য রকিকে খুন করা হয়েছিল। গত ৬ মে ওড়িশার গঞ্জাম জেলার রম্ভা থানার পুলিশ রকির দেহ উদ্ধার করে। গত ৯ মে ঝাড়গ্রাম এসিজেএম আদালতের নির্দেশে দশ দিনের জন্য তিন অভিযুক্তকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে দফায় দফায় জেরা করেছে পুলিশ। আজ, সোমবার ফের তিন অভিযুক্তকে আদালতে তোলা হবে। ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “অশোক-সহ তিন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। অপহরণে ব্যবহৃত গাড়িটি আটক করা হয়েছে। অপহরণে ব্যবহৃত পিস্তলটি-সহ আরও বেশ কিছু জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। শীঘ্রই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে।”
তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ২৫ এপ্রিল ব্যবসার টোপ দিয়ে ঝাড়গ্রাম শহরের রাস্তা থেকে রকিকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল অশোকের সঙ্গীরা। তারপর পিস্তল ঠেকিয়ে রকিকে ঝাড়গ্রামের একটি ডেরায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ইঞ্জেকশন দিয়ে রকিকে সংজ্ঞাহীন করে ওড়িশায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অপহরণের পর নিজের গাড়িতে করেই রকিকে ওড়িশার গোপন ডেরায় নিয়ে গিয়েছিলেন অশোক। শনিবার সিআইডির ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞরা’ ঝাড়গ্রামে এসে গাড়িটি পরীক্ষা করে দেখেন, নমুনা সংগ্রহ করেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, মুক্তিপণ বাবদ মোটা টাকা আদায়ের জন্য রকির বাড়িতে ডাকযোগে মেমোরি চিপ পাঠিয়েছিল অপহরণকারীরা। তাতে ভিডিও ক্লিপিংসে গামছায় চোখবাঁধা অবস্থায় রকির কপালে ওই পিস্তলটি ঠেকানো ছিল। পুলিশের দাবি, বাজেয়াপ্ত করা ওই পিস্তলটি অশোক শর্মার। অশোক-সহ রকি হত্যাকাণ্ডের তিন অভিযুক্তের কাছ থেকে চারটি মোবাইল ফোন ও ভিন্ রাজ্যের কয়েকটি সিম কার্ডও বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। এর মধ্যে একটি ফোন থেকে বিভিন্ন সিম কার্ড ব্যবহার করে রকির পরিবারের কাছে ৩ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল।
পুলিশ জানিয়েছে, এই ঘটনায় ধৃত অশোক ও তাঁর পরিচারক টোটন জেরায় পরিকল্পনা করে খুনের কথা কবুল করেছেন। এই ষড়যন্ত্রে অশোকের ভাইপো সুমিতও জড়িত। পুলিশের দাবি, ঠিকাদারি ব্যবসার সূত্রে বছর দশেক আগেই অপরাধ জগতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে অশোকের। টাকার প্রয়োজনে আগেও ঝাড়খণ্ডে এমন একাধিক ঘটনায় অশোক জড়িয়েছিলেন। ঘাটশিলাতেও এক অপহরণ-কাণ্ডে তিনি অভিযুক্ত। এ ছাড়া ঘাটশিলায় এক ব্যবসায়ীকে গুলিতে জখম করার ঘটনাতেও অশোকের নাম জড়িয়েছিল। পুলিশের মতে, সম্প্রতি ঠিকাদারিতে লোকসানের দরুন কোটি টাকা দেনা হয়েছিল অশোকের। রকিও তাঁর কাছে টাকা পেতেন। রকির সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত রেষারেষিও ছিল অশোকের। তবে রকির পরিবারের সঙ্গে অশোকের ঘনিষ্ঠতা ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, এই পরিস্থিতিতে ‘সফ্ট টার্গেট’ রকিকে অপহরণ করে মোটা টাকা হাতানোর ছক কষেছিলেন অশোক। রকিকে অপহরণের পরেও একাধিক বার তাঁর বাড়িতে শুভানুধ্যায়ী হিসেবে খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রকির বাড়িতে পুলিশের আনাগোনা দেখে চিন্তায় পড়ে যান অশোক। ৪ মে ওড়িশার গোপন ডেরায় রকির চোখের বাঁধন আলগা হয়ে যাওয়ায় তিনি অশোককে দেখে ফেলেন। এরপর রকিকে বাঁচিয়ে রাখার ঝুঁকি নেয় নি অপহরণকারীরা।
ঝাড়গ্রামের বলরামডিহির বাসিন্দা রকিরা। তাঁর বাবা পবনকুমার অগ্রবালের ইমারতি সরঞ্জামের বড়সড় ব্যবসা রয়েছে। বাণিজ্যে স্নাতক রকি ইদানীং বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এমন তরতাজা একটি ছিলেন খুনের ঘটনায় ফুঁসছে ঝাড়গ্রাম। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের কঠিনতম শাস্তির দাবিতে গড়ে উঠছে জনমত। শনিবার সকালে রকির স্কুল কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনের পড়ুয়া ও শিক্ষকেরা শহরে পদযাত্রা করেন। রবিরার বিকেলে রবীন্দ্রপার্কে ঝাড়গ্রাম চেম্বার অফ কমার্সের উদ্যোগে রকির স্মরণসভা হয়।