বিজয়া দশমীর দিন নাগপুরের রেশম বাগে সঙ্ঘপ্রধানের বাৎসরিক বক্তৃতাতেই পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ এবং জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়ে সরব হয়েছিলেন মোহন ভাগবত। এ বার রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে সরাসরি ময়দানে নামতে চলেছেন তিনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সূত্রের খবর, আগামী ২০ ডিসেম্বর কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে জনসভা করবেন মোহন ভাগবত।
সঙ্ঘপ্রধান প্রকাশ্য জনসভা করছেন, এটা প্রায় বিরল ঘটনা। সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে যে বাৎসরিক বক্তৃতা, তাতে সঙ্ঘের সদস্যরাই উপস্থিত থাকেন। এ ছাড়া, সঙ্ঘ আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনাচক্রে নিজের মত প্রকাশ করেন সঙ্ঘপ্রধান। সঙ্ঘের অন্য কর্তারাও এই প্রথা মেনে চলেন। ১৯৫১-’৫২ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে এ রাজ্যে জনসভা করেছিলেন তৎকালীন সঙ্ঘপ্রধান মাধবরাও গোলওয়ালকর। জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পরে জনসভা করেন বালাসাহেব দেওরস। বছর সাতেক আগে কে এস সুদর্শন শহিদ মিনারে সভা করেছিলেন বটে, কিন্তু সেটা মূলত সঙ্ঘ-সদস্যদের সভাই ছিল। সেই অর্থে জনসভা নয়।
২০০৯ সালে সঙ্ঘপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পরে এই প্রথম জনসভা করতে চলেছেন মোহন ভাগবত। এবং রাজনৈতিক দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ যে হেতু ক্রমশই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার এই রাজ্যকে পাখির চোখ করছে, তাই সভাস্থল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে কলকাতাকে। শহিদ মিনারের সভার উপলক্ষ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ উদ্যাপন। ভাগবতের এই জনসভা থেকেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে দেশবিরোধী কাজকর্মের অভিযোগে রাজ্যব্যাপী প্রচার শুরু হবে বলে সঙ্ঘ সূত্রের বক্তব্য। ডিসেম্বরের সভায় অশোক সিঙ্ঘল, প্রবীণ তোগাড়িয়া এবং বাবা রামদেবের উপস্থিত থাকার কথা। সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই শহিদ মিনারে সভা করার অনুমতি দিয়েছে বলে পরিষদের এক কর্তা জানিয়েছেন।
এ বার বিজয়া দশমীর বক্তৃতায় তিন বার পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন ভাগবত। অনুপ্রবেশের ফলে কী ভাবে এ রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলির জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে এবং তা দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, সে কথাও বিস্তারিত বলেছিলেন তিনি। ভাগবত যে দিন এই ভাষণ দেন, ঠিক তার আগের দিন, ২ অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ হয়। ওই ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ-এর যোগসূত্র মিলেছে বলে তদন্তকারী সংস্থাগুলির দাবি।
সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার সত্ত্বেও অনুপ্রবেশকেই যে প্রধান হাতিয়ার করা হবে, সে কথা আগেই জানিয়েছিলেন সঙ্ঘ নেতৃত্ব। এত দিন ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির তাগিদে অনুপ্রবেশে মদত দেওয়ার অভিযোগই তাঁরা তুলছিলেন রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে। কিন্তু তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরানের সঙ্গে সিমি-র যোগসূত্র এবং সারদার টাকা বাংলাদেশে পাচার করে সেখানে সরকার বিরোধী সন্ত্রাসে মদত দেওয়ার অভিযোগ গোটা বিষয়টিতে অন্য মাত্রা এনে দেয়। তার পর খাগড়াগড়ের ঘটনা তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরাসরি দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে সঙ্ঘের সামনে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের দাবি, “এনআইএ তদন্তেই প্রমাণিত হবে এ রাজ্যে সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা তৃণমূল।” আর এক বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী তৃণমূলকে কার্যত জেহাদিদের পৃষ্ঠপোষক বলে আক্রমণ করেছেন। আরএসএসের এক কর্তা জানাচ্ছেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে এখন রাষ্ট্রদোহিতা এবং দুর্নীতি দুই অভিযোগ নিয়েই আন্দোলনে নামা হবে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, বফর্স কেলেঙ্কারির সময়।
আরএসএসের পূর্বাঞ্চলের (বাংলা, ওড়িশা, আন্দামান, সিকিম) ক্ষেত্রীয় প্রচারক অদ্বৈত দত্ত বলেন, “অনুপ্রবেশের ফলে এ রাজ্যের জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে শুধু নয়, অর্থনীতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদতে সন্ত্রাসবাদের শিকড় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাঙালির মধ্যে হিন্দু স্বাভিমান বোধ জাগানোই সঙ্ঘের উদ্দেশ্য।”
তৃণমূলের এক বরিষ্ঠ মন্ত্রী অবশ্য মনে করেন, সঙ্ঘের এই প্রচারে আদতে তাঁদেরই লাভ হবে। সঙ্ঘের হিন্দুকরণের চেষ্টার বিরুদ্ধে একজোট হবে রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট। ফলে প্রবল বিরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও ২০১৬-তে ক্ষমতায় ফিরে আসতে তাঁদের কোনও অসুবিধাই হবে না।
তৃণমূলের এই যুক্তি অবশ্য মানতে নারাজ বিজেপি। তাদের মতে, এ রাজ্যের সংখ্যালঘুরা তৃণমূলের দেশদ্রোহী অবস্থানকে সমর্থন করবেন এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। উদার, জাতীয়তাবাদী সংখ্যালঘুরা তাদের বিরুদ্ধেই যাবেন। তৃণমূল বড়জোর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট পেতে পারে। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যর কথায়, “অনুপ্রবেশকারীদের ভোট তৃণমূল পেতে পারে। কিন্তু যে সব সংখ্যালঘু এ রাজ্যের পুরনো বাসিন্দা, তাঁরা বিজেপি-কেই ভোট দেবেন। বসিরহাটে তেমনই ঘটেছে। বীরভূমের ইলামবাজার-নানুরেও সংখ্যালঘুরা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন।”
লোকসভা ভোটের পরে বিজেপির প্রতি আগ্রহ বাড়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এ রাজ্যে সংগঠন বিস্তার করতে উদ্যোগী সঙ্ঘ পরিবার। চলতি বছরের মধ্যে রাজ্যের ৩৪১টি ব্লকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা স্থাপন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যে অনুপ্রবেশের মতো বিষয়কে সামনে রেখে বাড়ি-বাড়ি প্রচারে যাওয়া হবে। অদ্বৈত দত্ত জানান, গত কয়েক মাসে যে সব যুবক আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তাঁদের সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
এই মুহূর্তে তাঁতিবেড়িয়া, কাঁথি, ঝাড়গ্রাম, তমলুক, মেদিনীপুর, সুন্দরবন, বারাসত, বাঁকুড়া, বীরভূমে এই ধরনের শিবিরে ১৪৯৩ জন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তার মধ্যে শুধু সুন্দরবন থেকেই ৫৫০ জন সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরে এসেছে বলে জানিয়েছেন অদ্বৈতবাবু।
কলকাতায় সঙ্ঘপ্রধানের সভাও এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রতিফলন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সূত্রের খবর, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই এত দিন কোনও সর্বভারতীয় সভা-সমাবেশের জন্য কলকাতাকে বাছা হতো না। অথচ এ বার কলকাতা থেকেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান শুরু করছে। তার পর সমাবেশ হবে দিল্লি, মুম্বই, ভোপাল ও বেঙ্গালুরুতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy