Advertisement
E-Paper

দুবাই থেকে বাংলাদেশ ঘুরে টাকা বর্ধমানে

বর্ধমান বিস্ফোরণের জেহাদি-নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরের দুবাইয়েও। এ বার এমনই সূত্র হাতে এসেছে গোয়েন্দাদের।খাগড়াগড়ের তদন্তে প্রায় প্রতিদিনই এখন নতুন নতুন জায়গার নাম উঠে আসছে রাজ্যের অন্যত্র, রাজ্যের বাইরে। দেশেরও বাইরে। তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, খাগড়াগড়ের হাসান চৌধুরীর বাড়ির দোতলায় যে সব পুরুষ ও মহিলা আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বানাত, তাদের নিয়মিত মাসোহারার বন্দোবস্ত ছিল। এবং সেই টাকা বাংলাদেশি কিছু ব্যবসায়ীর দৌলতে হাওয়ালার মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দুবাই থেকে বাংলাদেশ হয়ে বর্ধমানে পৌঁছত।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০১
গ্রেফতার হওয়ার পরে মৌলানা আনোয়ার খান। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

গ্রেফতার হওয়ার পরে মৌলানা আনোয়ার খান। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

বর্ধমান বিস্ফোরণের জেহাদি-নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরের দুবাইয়েও। এ বার এমনই সূত্র হাতে এসেছে গোয়েন্দাদের।

খাগড়াগড়ের তদন্তে প্রায় প্রতিদিনই এখন নতুন নতুন জায়গার নাম উঠে আসছে রাজ্যের অন্যত্র, রাজ্যের বাইরে। দেশেরও বাইরে।

তদন্তকারীদের একাংশের দাবি, খাগড়াগড়ের হাসান চৌধুরীর বাড়ির দোতলায় যে সব পুরুষ ও মহিলা আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বানাত, তাদের নিয়মিত মাসোহারার বন্দোবস্ত ছিল। এবং সেই টাকা বাংলাদেশি কিছু ব্যবসায়ীর দৌলতে হাওয়ালার মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দুবাই থেকে বাংলাদেশ হয়ে বর্ধমানে পৌঁছত। গোয়েন্দাদের ধারণা, আইইডি তৈরির জন্য মালমশলা, রাসায়নিক ও অন্য সরঞ্জাম কেনার প্রয়োজনীয় অর্থও বিদেশ থেকে এসেছে।

আবার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবি সূত্রের খবর, শুধু বাংলাদেশ নয়, নামনি অসম থেকেও নিয়মিত লোকজন আসত খাগড়াগড়ে। মূলত কোকরাঝোড়, বরপেটা থেকে লোক এসে প্রশিক্ষণ দিত শাকিলের সঙ্গীদের। জেহাদ নিয়ে মগজধোলাই করত।

রাজ্য গোয়েন্দা দফতরের এক শীর্ষ কর্তা ঘনিষ্ঠ মহলে মানছেন, “ঠিক যেন মনে হচ্ছে, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানো হচ্ছে। বিস্ফোরণ না হলে বোঝাই যেত না এরা (জঙ্গিরা) কত দূর পর্যন্ত শিকড়বাকড় ছড়িয়েছে। এখন ভাবছি, ভাগ্যিস বিস্ফোরণটা হয়েছিল!”

জঙ্গিদের সম্ভাব্য আস্তানা হিসেবে এখন গোয়েন্দা-নজরে রয়েছে বর্ধমান শহরের আরও কিছু এলাকা। তদন্তকারীদের অনুমান, এই জঙ্গি-নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সবিস্তার জানতে হলে প্রধান অভিযুক্ত পলাতক কওসরকে হাতে পেতেই হবে।

তবে মঙ্গলবার রাত ও বুধবার দিনভরের তদন্তে বিস্ফোরণস্থল থেকে মাত্র আধ কিলোমিটার দূরে জেহাদিদের আরও দু’টি ডেরার হদিস মিলেছে। যার মধ্যে বর্ধমান জেলা সদরের বাবুরবাগের একটি ভাড়াবাড়িও রয়েছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, কওসর ওখানেই থাকত।

কওসরের ঘনিষ্ঠ বীরভূমের দুই বাসিন্দা কাদের এবং মহম্মদ আলির নামও জানতে পেরেছে সিআইডি। এও জানা গিয়েছে, খাগড়াগড় বিস্ফোরণস্থল থেকে যে মোটরবাইকটি পাওয়া গেছে সেটির রেজিস্ট্রেশন করানো হয়েছে নদিয়া জেলায়। ওই বাইক চালিয়ে বীরভূমের কীর্ণাহারে যাতায়াত করত কাদের। এর পাশাপাশি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাসনাবাদ থেকে বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন ‘জামাতে ইসলামি বাংলাদেশি’-র (জেএমবি) দুই সদস্যকে ধরেছে পুলিশ। তাদের এক মহিলা সঙ্গীরও খোঁজ চলছে। সাতক্ষীরা জেলার পাঁচপোতা গ্রামের বাসিন্দা ওই দুই যুবকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একাধিক নাশকতামূলক কাজকর্মের অভিযোগ আছে পুলিশের দাবি। তারা মাস আটেক আগে পালিয়ে এ দেশে এসেছিল। ডেরা বেঁধেছিল বাদুড়িয়ার ঈশ্বরীগাছা এবং স্বরূপনগরে। ধৃতদের নাম মহম্মদ ফারুখ হোসেন সর্দার ও মহম্মদ সাদ্দাম হোসেন শেখ সর্দার। তাদের কাছ থেকে ৬ হাজার জাল ভারতীয় টাকা পাওয়া গিয়েছে। এই দু’জনের সঙ্গে বর্ধমান বিস্ফোরণের যোগ আছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।এ দিকে সিআইডি জানতে পেরেছে, প্রথমে নিজেকে নিরীহ বলে দাবি করলেও খাগড়াগড় বিস্ফোরণে জখম আব্দুল হাকিম এক জন বিস্ফোরক এবং বোমা বিশেষজ্ঞ। মুর্শিদাবাদের লালগোলার মোকামনগরের একটি মাদ্রাসায় গিয়ে বেশ কয়েক বার জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছিল আব্দুল। এমনকী, সন্দেহভাজন কয়েক জন বাংলাদেশির সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ করত সে। তার স্ত্রী আলিমা বিবিও জেএমবি-র সদস্য বলে সিআইডি’র সন্দেহ। এ দিন বীরভূমের মহম্মদবাজারের দেউচা গ্রামে, আব্দুল হাকিমের বাড়িতে সিআইডি-র একটি দল যায়। এ দিন বিকেলে খাগড়াগড় থেকে ধৃত আলিমা ও রাজিয়া বিবিকে ভবানী ভবনে আনা হয়। আলিমার কাছ থেকে পাওয়া সূত্র ধরেই বাবুরবাগের ডেরা সম্পর্কে জানতে পেরেছে পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার দুপুরে গাড়িতে করে বর্ধমান মেডিক্যালে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাজিয়া ও আলিমাকে। বাবুরবাগ এলাকার উপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে আলিমার চোখমুখের ভাব দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়। তখনই দু’টি জায়গার নাম উঠে আসে বাবুরবাগ ও বাদশাহি রোডের মাঠ। পুলিশ জানতে পারে, বাবুরবাগে হাজি রেজ্জাক মোল্লার (এখন আটক) বাড়িতে গত দু’মাস ধরে দু’জন মহিলা ও দু’জন পুরুষ ভাড়া ছিল। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ওই দোতলা বাড়িটির একতলায় কিছু ছাত্র ভাড়া থাকেন। উপরে থাকত ওই চার জন। খাগড়াগড়ের মতো এখানেও দুই মহিলা সব সময় বোরখা পরে থাকত।

মঙ্গলবার রাত ২টো নাগাদ ওই বাড়ির তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকে পুলিশ এবং সিআইডি। সেখান থেকে উদ্ধার হয় দু’টি নাইন এমএম পিস্তল ও তার ২৩ রাউন্ড কার্তুজ, দু’টি ৭.৬৩ পিস্তল ও তার ৩৯ রাউন্ড কার্তুজ, জঙ্গি সংগঠনের কিছু চিঠিপত্র, কওসরের নাম লেখা একটি ডাক্তারি প্রেসক্রিপশন ও সিটি স্ক্যানের ছবি, প্রায় সত্তর কেজি বিস্ফোরক তৈরির উপাদান, যার মধ্যে রয়েছে পটাশিয়াম নাইট্রেট, সালফিউরিক অ্যাসিড, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট-সহ বেশ কিছু রাসায়নিক। মেলে বেশ কিছু পোড়া কাগজ, নষ্ট করে দেওয়া মোবাইলের সিমকার্ড, ব্যাটারি এবং মোটরবাইক চালানোর লাইসেন্স।

স্থানীয় সূত্রের খবর, ছুরি-কাঁচির ব্যবসা করবে বলে প্রথমে হাবিবুল্লা বলে বীরভূমের এক বাসিন্দা বাবুরবাগের বাড়িটির দোতলায় তিনটি ঘর ভাড়া নেয়। সেখানে থাকতে শুরু করে চার জন। প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, এক ব্যক্তির ভাল চেহারা, গায়ের রং ফরসা। সে-ই কওসর বলে গোয়েন্দাদের ধারণা।

বাবুরবাগ এলাকার বাসিন্দারা জানান, ব্যাগ হাতে সন্ধ্যা ৬টার পরে কোনও দিন নীল-কালো, কোনও দিন লাল রঙের মোটরবাইকে চড়ে বাড়িটির দোতলার ভাড়াটে ওই যুবকেরা আসত। তাদের মুখ ঢাকা থাকত হেলমেটে। প্রতিবেশী সালেমা বিবি বলেন, “ওদের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ থাকত। নীচের তলার ছাত্রদের জামাকাপড় শুকোতে ছাদে যেতে দিত না ওরা। তা নিয়ে তর্কাতর্কিও হয়েছে।” খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ দরজা-জানালা খোলা রেখেই বেরিয়ে গিয়েছিল ওই চার জন।

বাবুরবাগের বাড়িটিতে তল্লাশির পরে তদন্তকারীরা পৌঁছন বাদশাহি রোডের মাঠপাড়ায়। সেখানে মন্টু শেখ ও তার ছেলে রেজাউল শেখের নির্মীয়মাণ বাড়িটি তালাবন্ধ ছিল। তালা ভেঙে ঢুকে তল্লাশি চালানো হয়। তবে কিছু মেলেনি। গোয়েন্দাদের দাবি, রেজাউলের সঙ্গে পরিচয় ছিল বিস্ফোরণে নিহত শাকিল আহমেদের। শাকিলের মোবাইলের কল-লিস্টে রেজাউলের নাম পাওয়া গিয়েছে।

রবিবারই গোয়েন্দারা মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বড়ুয়া মোড়ে শাকিল আহমেদের দোকান ‘বোরখা ঘর’-এ তল্লাশি চালান। জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক এ দিন শীর্ষকর্তা জানান, বেলডাঙায় বোরখা তৈরির নামে শাকিলেরা যে ৪টি ঘর ভাড়া নিয়েছিল, সেখানেই বারুদ মজুত করত। “পরে সেখান থেকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হতো বলে অনুমান।”

মঙ্গলবার রাতে বেলডাঙা থেকেই বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনাবেচার অভিযোগে একটি অনুমোদিত মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষক তথা মসজিদের এক ইমামকে ধরেছে পুলিশ। ধৃত মৌলানা আনোয়ার খান ওরফে আফসারের বয়স ৫২। জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “খাগড়াগড়-কাণ্ডের সঙ্গে আনোয়ারের যোগ থাকার সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।” কারণ, বেলডাঙায় শাকিলদের ডেরা থেকে রেজিনগরের অমরপুর গ্রামের দূরত্ব বড়জোর পাঁচ কিলোমিটার। অমরপুর গ্রামেরই একটি অনুমোদনহীন মাদ্রাসায় বহু দিন পড়িয়েছে মৌলানা। মুর্শিদাবাদ জেলা গোয়েন্দা দফতরের এক কর্তা বলেন, “যে সময়ে সস্ত্রীক শাকিল ও হাকিম বোরখা ঘর থেকে কারবার করত, একই সময়ে অমরপুর গ্রামে মৌলানা আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরকের কারবার চালিয়েছে। দু’পক্ষের যোগ থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট।”

মৌলানার সঙ্গে ধরা হয়েছে আরও ৪ জনকে। তাদের কাছে ৬টি পাইপগান, ৭.৬২ বোরের দু’টি পিস্তল, দু’টি গাদা বন্দুক, চারটি ম্যাগাজিন, ১৭ রাউন্ড গুলি এবং ১৪ হাজার টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, মৌলানার ছবি এ দিন দুপুরেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্য পুলিশ ও গোয়েন্দা-কর্তাদের কাছে।

khagragarh blast case dubai money arab countries link bangladesh state news online state news Khagragarh bardhaman Khagragarh blast investigation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy