Advertisement
E-Paper

জখম প্রৌঢ়কে পুনর্জন্মের সঙ্গে ঠিকানাও দিলেন চিকিৎসকেরা

চিকিৎসক তো বটেই, তিনি তখন মুখ্যমন্ত্রীও। বলেছিলেন, ‘‘এ রাজ্যে রোগের চিকিৎসার চেয়েও বেশি প্রয়োজন রোগীর প্রতি সহমর্মিতার।’’

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৬ ০৪:০১
হাসপাতাল থেকে নতুন ঠিকানায় ফিরছেন অজিত চক্রবর্তী।—নিজস্ব চিত্র।

হাসপাতাল থেকে নতুন ঠিকানায় ফিরছেন অজিত চক্রবর্তী।—নিজস্ব চিত্র।

চিকিৎসক তো বটেই, তিনি তখন মুখ্যমন্ত্রীও। বলেছিলেন, ‘‘এ রাজ্যে রোগের চিকিৎসার চেয়েও বেশি প্রয়োজন রোগীর প্রতি সহমর্মিতার।’’

সাগরময় ঘোষের ‘একটি পেরেকের কাহিনী’র সেই চিকিৎসক তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় যে-সহমর্মিতার কথা বলতে চেয়েছিলেন, তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন, ১ জুলাই ‘ডক্টরস ডে’-তে চিকিৎসকদের ঠিক তেমনই মানবিক মুখ দেখল বারাসতবাসী।

ট্রেনে ধাক্কা খেয়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলেন বছর পঞ্চাশের এক ব্যক্তি। দু’টি পা-ই কাটা গিয়েছিল। শুধু হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায়নি। গত ২০ অক্টোবরের ঘটনা। সেই দলাপাকানো মানুষটাকে টানা পাঁচ মাস অস্ত্রোপচারের পর অস্ত্রোপচার করে সুস্থ করে তোলেন বারাসত জেলা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। পুলিশ তাঁর ছবি নিয়ে বিস্তর খোঁজখবর করেছিল। কিন্তু ঠিকানা মেলেনি।

কিছুটা সুস্থ হয়ে ওই প্রৌঢ় নিজের নাম-ঠিকানা বলেন। সেই ঠিকানায় ছুটে গিয়েছিলেন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। কিন্তু বাড়ি গিয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা তো দূরের কথা, উল্টে মিলেছিল রীতিমতো তিরস্কার। রোগীর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এক সুরে জানিয়ে দেন, ‘‘ওর সঙ্গে আমাদের অনেক দিন কোনও সম্পর্ক নেই। ও-সব নিয়ে আমাদের বিরক্ত করবেন না।’’

তার পরেও অজিত চক্রবর্তী নামে ট্রেনে কাটা পড়া মানুষটিকে চলে যেতে বলেনি বারাসত হাসপাতাল। হাত দু’টি জোড় করে তিনি তখন শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলেন। সেই চোখের জলই সঙ্কল্পে দৃঢ় করে তোলে বারাসত হাসপাতালের মানস চাকি, শোভারাম মণ্ডলের মতো চিকিৎসকদের। তাঁদের কথায়, ‘‘এত দিন লড়াই করে মানুষটাকে বাঁচালাম। পরবর্তী জীবনটুকু দিতে পারব না?’’ প্রশ্ন নয়, এটা যে সহমর্মিতারই সঙ্কল্প, তার প্রমাণও দিলেন ওই ডাক্তারেরা।

অজিতবাবুর দেওয়া সূত্র ধরেই শুরু হয় তাঁর বাবা-মায়ের বাড়ির খোঁজ। সেখানে গিয়ে জানা যায়, বাবা-মা প্রয়াত হয়েছেন। তবে জেঠতুতো, খুড়তুতো ভাইবোনেরা আছেন। তাঁরা দাদাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে রাজি হন। প্রায় সাড়ে আট মাস বারাসত হাসপাতালে কাটিয়ে শুক্রবার অ্যাম্বুল্যান্সে অশোকনগরে ‘নিজের বাড়ি’ ফিরে গেলেন অজিতবাবু। পা নেই, তাই হাসপাতাল থেকেই ব্যবস্থা হয়েছে হুইলচেয়ারের। ডাক্তারদের উদ্যোগেই মিলেছে প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেট। মিলবে সরকারি মাসোহারা, প্রতিবন্ধী ভাতা।

এক সময় রিকশা চালিয়েই সংসার চালাতেন অজিতবাবু। বাদুড়িয়ার চাঁতরায় বিয়ে করে সেখানেই বাসা বেঁধে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে এখন সমর্থ। কিন্তু পারিবারিক অশান্তির জেরে বারাসতে থাকতেন। মধ্যমগ্রামে রেললাইন ধরে পারাপারের সময়েই ঘটে বিপত্তি। ছিন্নভিন্ন, রক্তে দলাপাকানো অজিতবাবুকে বারাসত হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন এলাকার মানুষ। তার পরে আর কেউ খোঁজ রাখেনি তাঁর।

শুক্রবারের বিকেল। বারাসত হাসপাতালে বিধানচন্দ্র রায়ের ছবিতে মালা। জেঠতুতো ভাই রামু চক্রবর্তীর সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন অজিতবাবু। অ্যাম্বুল্যান্সে উঠছেন। হাসপাতালের এক নার্স বললেন, ‘‘আস্তে, আস্তে তোলো। তাড়াহুড়োর কী আছে?’’ এক আয়া বললেন, ‘‘এমনি এমনিই ঘুরতে আসতে হবে কিন্তু। ভুলে যাবেন না তো!’’ এক কর্মী হুইলচেয়ার গুছিয়ে দিতে দিতে রামুবাবুকে বুঝিয়ে দিলেন, ‘‘এ ভাবে ঘোরালে ডাইনে যাবে আর এমন ভাবে ঘোরালে বাঁ দিকে। ঠিক আছে? কোনও অসুবিধা হলেই জানাবেন। আমরা আছি।’’

মাথা নেড়ে সায় দেন রামুবাবু। যেন ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’-এর সেই ‘সার্কিট’! যিনি প্রৌঢ়ের পুনর্বাসনের পরবর্তী পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে এগিয়ে এসেছেন। কোমায় চলে যাওয়া মানুষটি চিকিৎসকদের ভালবাসা আর সহমর্মিতায় প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। বাড়ি ফিরছেন অজিতবাবু।

কেমন লাগছে? অজিতবাবু নিরুত্তর। কথা নেই তাঁর ভাই রামুর মুখেও। নীরব বারাসত হাসপাতালের সুপার সুব্রত মণ্ডলও। ট্রেনে কাটা তালগোল পাকানো অজিতবাবুকে জীবন আর বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা প্রথমে নিয়েছিলেন তিনিই।

বৃষ্টি পড়ছে। ওঁরা কি কাঁদছেন? ঠিক বোঝা গেল না।

বৃষ্টি পড়েই চলেছে!

Doctor's day Patients Hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy