E-Paper

‘৭৮০০ মিটার উচ্চতায় আইস ওয়ালের মধ্যে পায়ের আঙুল গোঁজা, টানা ২২ ঘণ্টা এ ভাবেই দাঁড়িয়ে’

মিটার উচ্চতার পর থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবহার শুরু করেছিলাম। তা নিয়েই পৌঁছেছি সামিটে। সামিট থেকে নামার পথে এক সময়ে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করল।

পিয়ালি বসাক

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৩ ০৭:০১
An image of Piyali Basak

কাঠমান্ডুতে পৌঁছে পিয়ালি বসাক। ছবি: সংগৃহীত।

স্নো ব্লাইন্ডনেসের কারণে চোখে দেখছি না। ফুরিয়েছে সিলিন্ডারের অক্সিজেনও। আমায় রেখে নেমে গিয়েছেন সঙ্গী দুই শেরপাও। ৭৮০০ মিটার উচ্চতায় আইস ওয়ালের মধ্যে পায়ের আঙুল গুঁজে, না ঘুমিয়েই কাটিয়েছি সারাটা রাত। টানা ২২ ঘণ্টা এ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পরে এসেছেন উদ্ধারকারী শেরপারা। আমি বেঁচে থাকব, এটা ওঁরাও ভাবেননি। বলছেন, আমি নাকি ‘অত্যাশ্চর্য কিছু’ ঘটিয়েছি।

মঙ্গলবার রাতে মাকালুর সামিটে যাওয়ার পথে সাইজ়ে বড় স্নো-গগল্‌সটা সমস্যা করছিল, তাই খুলে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। এভারেস্টের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলাম, এর জন্য ঠান্ডায় যদি চোখের যন্ত্রণা বা স্নো-ব্লাইন্ডনেস শুরু হয়ও, তা হলেও তার আগেই সামিট ছুঁয়ে ক্যাম্প ৪-এ পৌঁছে যাব। ১২ ঘণ্টা পরে ঠিক হয়ে যাবে। তবে যাওয়ার সময়েই শেরপার পরামর্শ মতো প্রায় ৮ হাজার

মিটার উচ্চতার পর থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবহার শুরু করেছিলাম। তা নিয়েই পৌঁছেছি সামিটে। সামিট থেকে নামার পথে এক সময়ে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করল। যাঁরা আগে নেমেছেন, তাঁদের পায়ের ছাপও আর দেখা যাচ্ছে না। এ সময়ে আমাদের সঙ্গী হলেন আরও এক শেরপা। চার জনে মিলে কোমরে দড়ি বেঁধে নামছিলাম। আট হাজার মিটার উচ্চতার কাছাকাছি এসে দেখি, বরফের ঢালে ‘ব্লু আইস’। সেখানে পায়ে লাগানো ক্র্যাম্পনও লাগানো যাচ্ছে না। ঢাল দিয়ে চার জনে আড়াআড়ি এগোচ্ছি। দেখি, ‘সেভেন সামিট’ সংস্থার এক পর্বতারোহী ক্রিভাসে পড়ে গিয়েছেন, তাঁর ক্র্যাম্পনও হারিয়ে গিয়েছে।

আমার তিন শেরপা সঙ্গী তাঁকে উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সেখানে আমাদের অনেকটা সময় চলে যায়, তবু তাঁকে তোলা যাচ্ছিল না। শেষে ওয়াকিটকিতে খবর পাঠানো হলে নীচ থেকে শেরপারা এসে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।

তত ক্ষণে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। আমার চোখে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। দেখতে পাচ্ছি না। আমার দুই শেরপা সঙ্গীর (তাঁরা বাবা-ছেলে) ততক্ষণে নজর পড়েছে আমার উপরে। তাঁরা আমায় নীচে নামার জন্য তাড়া দিতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুতেই ওঁদের বোঝাতে পারছি না যে, আমি কিছু দেখতেই পাচ্ছি না! এক পা-ও এগোব কী করে? তৃতীয় শেরপা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছেন, তাঁকেও সমস্যার কথা জানাতে পারছি না। ওয়াকিটকিতে নীচে সাহায্যের কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু শেরপারা সেটিও আমার হাতে দিতে চাননি।

সন্ধ্যায় এক সময়ে ওঁরা আমায় সেখানে রেখেই নেমে গেলেন। খাড়া আইস ওয়ালে একা দাঁড়িয়ে আমি, চোখে অসহ্য যন্ত্রণা। পায়ের চার আঙুল গেঁথে দাঁড়িয়ে রয়েছি। তাই তো পায়ের ওই চারটে আঙুলেই ফ্রস্টবাইট হয়েছে। হাতে যাতে ফ্রস্টবাইট না হয়, সে জন্য দু’পায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে নিয়েছি। সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হলেও জোরে জোরে শ্বাস নিয়েছি, আর লক্ষ রেখেছি, যেন কোনও ভাবেই ঘুমিয়ে না পড়ি। কারণ, তখন ওই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লেই বিপদ! মনে হচ্ছে, এত কষ্ট করে সামিট করেও শেষে এই ছিল কপালে! পরে আবার এটাও ভাবছি, পরিজনের কাছে ফিরতেই হবে, তাই মনের জোর হারালে চলবে না।

সে রাতে জোরে হাওয়া চলছিল বলে কোনও দলই সামিটের দিকে যায়নি। তবে এক জন শেরপার সঙ্গে দেখা হয়েছিল সে রাতে, সামিটের দিকে যাচ্ছেন। আশ্বাস দিয়ে গেলেন, সকালে নিশ্চয় সাহায্য আসবে। কিন্তু পর দিন সারা সকাল কেউ আসেননি। ওই শেরপা সামিট করে নামার সময়ে আমাকে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীচে গিয়ে খবর দেন। তখন, বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে তিন শেরপা আসেন উদ্ধার করতে! কখনও হেঁটে, কখনও তুলে নীচে নিয়ে এসেছেন ওঁরা আমায়। ওঁরা ভাবতেও পারেননি, সারা রাত খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আমি বেঁচে থাকব।

আজ, শনিবার সকালে হেলিকপ্টারে বেসক্যাম্প থেকে লুকলা হয়ে কাঠমান্ডু পৌঁছেছি। হাসপাতালের ডাক্তার বলেছেন, ফ্রস্টবাইট তেমন গুরুতর নয়। কয়েক দিন পরেই বাড়ি ফিরতে পারব।

অনুলিখন: স্বাতী মল্লিক

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Piyali Basak Mount Makalu Mountaineer

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy