মুষড়ে পড়েছে রাজা। প্রবল গরমে মাথা থেকে ‘রাজছত্র’ যে সরে যাচ্ছে! যে ছাতার তলায় রাজা এতদিন রাজ্যপাট চালিয়েছে বলে নিজেই দাবি করে এসেছে, সেই ছাতা কি না তার ‘বিদ্রোহী’কেই ছায়া দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে!
হালিশহরের রাজা দত্ত যাতে ‘রায়বাড়ি’র ধারে-কাছে না যায়, ইতিমধ্যে সেই নির্দেশ পেয়েছে তার চ্যালারা। তার উপর শুক্রবার বারেন্দ্র গলির সমাজপতি-বাড়িতে গিয়ে স্থানীয় বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়ের বাবা, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুলবাবু দোষীর শাস্তির আশ্বাস দিয়ে এসেছেন। হালিশহরের ওই বাড়িতেই ভোটের আগের রাতে উপ-পুরপ্রধান রাজার দলবলের বিরুদ্ধে (২৪ এপ্রিল) হামলার অভিযোগ ওঠে।
সমাজপতি বাড়ির মেয়ে দেবশ্রী ঘোষকে মুকুলবাবু বলেন, ‘‘দোষ যে-ই করুক না কেন, শাস্তি সে পাবেই।’’ শুক্রবার ফোন করে দেবশ্রীকে একই আশ্বাস দেন এলাকার তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীও। দেবশ্রীকে ‘লড়াই’ চালিয়ে যাওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
এ কথা জানার পর থেকেই রাজা মুষড়ে পড়ে বলে দাবি তার শাগরেদের। ওই শাগরেদ জানিয়েছে, মুকুলবাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে ‘দাদা’। কিন্তু মুকুলবাবু দেখা করছেন না। দেবশ্রীদের বাড়ি যাওয়ার সময়েও ‘দাদা’ মুকুলবাবুর সঙ্গী হতে চায়। কিন্তু ‘দাদা’র ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তার পরই ‘দাদা’ ভেঙে পড়ে। রাজাকে নিয়ে কোনও প্রশ্নের উত্তর মুকুলবাবু দিতে চাননি। তিনি আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘শহরে ফিরেই ওঁদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওঁদের বলেছি, ওই ঘটনা ঘটা উচিত হয়নি। এ-ও বলেছি, দেবশ্রীরা যেন নিজের রাজনীতি থেকে সরে না আসেন। দোষীরা শাস্তি পাবেই।’’ মুকুলবাবুর আশ্বাসের কথা শোনার পরে স্থানীয়রা মনে করছেন, রাজার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছেন মুকুলবাবুরা। তা না হলে রাজার যাবতীয় ‘অপকর্মে’র দায়ও তাঁদের ঘাড়ে চলে আসবে। বিরোধীরা মনে করছে, ভোটে শুভ্রাংশুর হার-জিত যাই হোক না কেন, রাজার সঙ্গে সংস্রবের কথা সামনে এলে তাঁর ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে। তাই রাজাকে এড়িয়ে চলারই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। মুকুলবাবুও ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, এখনও নির্বাচনী-বিধি বলবৎ থাকায় তিনি ওই পরিবারকে সাহায্য করতে গেলে, তার অন্য মানে করা হবে। এমনকী দেবশ্রীর শিশুকন্যা সায়ন্তিকাকে চকোলেট দিলেও! তাই ভোটের ফল প্রকাশের পর দেবশ্রীদের তিনি যোগাযোগ করতে বলেছেন।
পরিবারের কেউ যাতে ভোট দিতে না যান, সে জন্য ভোটের আগের রাতে বারেন্দ্র গলির টিটু সমাজপতির বাড়িতে রাজার দলবলের হামলায় টিটুবাবু এবং তাঁর মেয়ে দেবশ্রী মার খান বলে অভিযোগ। রেয়াত করা হয়নি দেবশ্রীর ৩ বছরের সায়ন্তিকাকেও। তা সত্ত্বেও ভোট দেন দেবশ্রী। ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেন পড়শিদের। সেই সময় বিধায়ক শুভ্রাংশু ওই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিলেও একবারও ওই বাড়িতে যাননি। শুভ্রাংশুর ফোনও তাঁরা পাননি বলে দেবশ্রীরা জানিয়েছিলেন। এর পরেই রাজা দত্তের নানা কীর্তি-কাহিনি সামনে আসতে থাকে। স্থানীয় লোকজন এবং বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, ‘রায়বাড়ি’ পাশে থাকাতেই রাজা এমন বেপরোয়া।
সেই হামলার ১১ দিন পরে, শুক্রবার দুপুরে দেবশ্রীদের বাড়িতে কোনও তৃণমূল নেতার পা পড়ল। প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পরে মুকুলবাবু দেবশ্রীর সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলে সেই রাতের ঘটনা শোনেন। দেবশ্রী তাঁর কাছে অভিযোগে জানান, রাজার দলবল যা করছে, তাতে সুস্থ ভাবে বাস করা সম্ভব নয়। দেবশ্রীর দাবি, মুকুলবাবু তাঁর সংসারের খুঁটিনাটি, ছেলের পড়াশোনা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চান। রাজনীতি করলে পড়াশোনাও করতে হয় বলে মুকুলবাবু দেবশ্রীকে পরামর্শও দিয়েছেন। তবে, দেবশ্রী তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁর বাবা বাম সমর্থক হলেও তিনি রাজনীতিতে জড়িত নন। মুকুলবাবুকে কোনও সাহায্যের প্রয়োজন নেই জানিয়ে শুধু রাজার শাস্তির দাবি করেন দেবশ্রী। শুভ্রাংশু একবারও না আসায় ক্ষোভও প্রকাশ করেন (ঘটনাচক্রে, এ দিন ওই সময়ে শুভ্রাংশু ওই বাড়ির কাছেই রামপ্রসাদের ভিটেতে বাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মুকুলবাবু ফিরলে দু’জনে একসঙ্গে সেখানে পুজোও দেন)। মুকুলবাবু অবশ্য তখন তাঁকে বলেন, ‘‘ভোট মিটতেই বাড়ি ফিরে আমি তো এসেছি।’’ দেবশ্রী বলেন, ‘‘মুকুলবাবু প্রায় আধ ঘণ্টা ছিলেন। রাজার কথা কিছু না বললেও দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন। দেখা যাক, কী হয়!’’
সাংসদ দীনেশবাবু আনন্দবাজারকে জানিয়েছেন, ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত করে কড়া পদক্ষেপ করার জন্য তিনি ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন। পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ বলেন, ‘‘খুবই সংবেদনশীল বিষয়। পুলিশ পুরো নজর রাখছে। কড়া পদক্ষেপই করা হবে।’’
শহর জুড়ে এখন একটাই প্রশ্ন। রাজার এ বার কী হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy