Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আর ঘরে ফেরা হয়নি মাস্টারের

তখন রাত প্রায় ৯টা। সকাল থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। জুন মাস। এ দিকের মহল্লায় তখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছয়নি। একে অন্ধকার রাত, তার দোসর বৃষ্টি— ফাঁকা হয়ে গিয়েছে রাস্তাঘাট।

এই নালাতেই মিলেছিল মৃতদেহ।—নিজস্ব চিত্র

এই নালাতেই মিলেছিল মৃতদেহ।—নিজস্ব চিত্র

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
মাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০১৬ ০১:২০
Share: Save:

তখন রাত প্রায় ৯টা। সকাল থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। জুন মাস। এ দিকের মহল্লায় তখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছয়নি। একে অন্ধকার রাত, তার দোসর বৃষ্টি— ফাঁকা হয়ে গিয়েছে রাস্তাঘাট।

বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই দেখে অসুস্থ কর্মীকে দেখতে সুনসান রাতেই বেড়িয়ে পড়েছিলেন মোর্তেজ মাস্টার। স্ত্রীকে বলেছিলেন— ‘‘যাব আর আসব। বেশি দূরের রাস্তা তো নয়। মেরেকেটে এক কিলোমিটার।’’ মাড়গ্রামের গুড়পাড়ার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আর ফেরা হয়নি সকলের প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের! খেদাপাড়া থেকে অসুস্থ কর্মীকে দেখে ফেরার পথেই খুন হন কংগ্রেস নেতা মোর্তেজ আলি (৫০)।

বাতাসে এখন ভোটের গন্ধ। মাড়গ্রামের রাস্তার দু’ধারে দেওয়াল লিখন তা জানান দিচ্ছে। বেশির ভাগ দেওয়ালের দখল অনেক দিন আগেই তৃণমূলের দখলে চলে গিয়েছে। কিছুটা হলেও প্রচারে পিছিয়ে বাম-কংগ্রেস শিবির। কে প্রার্থী— সংশয় কাটেনি তা নিয়েও। হাঁসন বিধানসভার অন্তর্গত এই এলাকায় রাজনৈতিক হানাহানি এখন তেমন নেই। তবে সে দিন একেবারে যে হারিয়ে যায়নি তার প্রমাণ কিছু দিন আগেই তিন যুবকের বোমা ফেটে জখম হওয়া। পুলিশের মত, সে দিনের খুনের পিছনে ছিল এলাকায় ভোট সর্বস্ব ক্ষমতা দখলের রাজনীতি।

সময়টা ১৯৯৫ সালের ১৮ জুন। মাড়গ্রামের কেদাপাড়ায় আন্দাজ ন’টা নাগাদ আচমকা বোমার আওয়াজে এলাকা কেঁপে ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, কিছু সময় পরেই আরও বেশ কিছু বোমা ফাটে। অসুস্থ কর্মীকে দেখে ফেরার পথে ছত্রভঙ্গ হয়ে যান কংগ্রেস কর্মীরা। হুঁশ ফিরতেই তাঁদের খেয়াল হয় মাস্টারমশাই কই? শুরু হয় খোজাখুঁজি। গভীর রাতে এলাকার একটি নালার মধ্যে থেকে উদ্ধার হয় মোর্তেজ মাস্টারের ক্ষতবিক্ষত দেহ। পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, এলাকার একটি বাঁকা গলির পথ পেরিয়ে যাওয়ার সময় দুষ্কৃতীরা প্রথমে বোমা মেরে তারপর কুপিয়ে, গুলি করে খুন করে বাংলার ওই শিক্ষককে।

•অসুস্থ কর্মীকে দেখে ফেরার পথেই খুন হন মাড়গ্রামের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা মোর্তেজ আলি (৫০)।

• সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই তাঁকে খুন করে বলে অভিযোগ।

• ২০১৩ সালে সাত জনকে দোষী সাব্যস্ত করে নিম্ন আদালত।

• অভিযুক্তেরা জামিনে মুক্ত। বিচারের অপেক্ষায় নিহতের ছেলে।

গুড়পাড়ার বাসিন্দা মোর্তেজ স্থানীয় হাই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। মাড়গ্রাম ১ পঞ্চায়েতের প্রাক্তন এই প্রধান এলাকায় মোর্তেজ মাস্টার নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ঘটনার সময়, ওই বছর জুন মাসে সিপিএম পরিচালিত রামপুরহাট ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে মোর্তেজের নেতৃত্বে অনাস্থা আনে কংগ্রেস। তারপরেই খুন হন তিনি। ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন কংগ্রেসের সে সময়ের নেতা সুজাউদ্দিন। বর্তমানে তিনি মাড়গ্রাম ১ পঞ্চায়েতের প্রধান। কংগ্রেসের প্রতীকে জেতার পর দলবদলে এখন তৃণমূলে। এই সুজাউদ্দিন সেই সময় ১৯ জন সিপিএম কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।

পুলিশ সূত্রে খবর, ওই দিন পাঁচ কংগ্রেস সমর্থক বোমায় জখম হয়েছিলেন। এক কংগ্রেস কর্মীকে রামপুরহাট হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। খুনের প্রতিবাদে পরের দিন কংগ্রেস কর্মীরা ৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুঠপাট চালায় বলেও অভিযোগ। শাখিল শেখ নামে একজনকে বেধড়ক মারধর করে উত্তেজিত জনতা। এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়। দুর্গাপুর থেকে পুলিশের বিশেষ বাহিনী এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছিল।

মোর্তেজ মাস্টার খুনের মামলা দীর্ঘ দিন চলে রামপুরহাট আদালতে। পুলিশের দাবি ছিল, প্রথম দিকে কেই সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে সাক্ষী মিললেও ওঠে টালবাহানার অভিযোগ। পুলিশ সূত্রের দাবি, তাতে দীর্ঘায়িত হয় মামলা। শেষমেষ, ২০১৩ সালের ২০ অগস্ট সাত জনকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন রামপুরহাট আদালতের অতিরিক্ত ও দায়রা বিচারক গুরুপদ মণ্ডল। সাজাপ্রাপ্ত দের মধ্যে ছিলেন সিপিএমের এক লোকাল কমিটির সম্পাদক, দুই প্রাক্তন প্রধান। এঁরা প্রত্যেকেই সিপিএম নেতাকর্মী। মামলায় মোট ১৯ জনের নামে অভিযোগ ছিল। বিচার প্রক্রিয়ার মাঝেই কচি আব্বাসি ও নবু শেখ নামে দুই অভিযুক্ত মারা যান। বাকি ১৭ জনের মধ্যে ১০ জন বেকসুর খালাস পেয়ে যান। বাকি সাত জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়। পরে প্রত্যেকেই উচ্চ আদালতে জামিন পেয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news murde dead body school master
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE