Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শ্লীলতাহানির তদন্ত রিপোর্ট কোথায়, কলরবে কুলুপ

যাদবপুরের যে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগের জেরে ‘হোক কলরব’ আন্দোলন হয়েছিল, যে আন্দোলনের জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে পুলিশ ঢুকেছিল, পদত্যাগ করতে হয়েছিল উপাচার্যকে— এক বছর পরেও সেই ঘটনার তদন্ত রিপোর্টই জমা পড়েনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতিতে।

সুপ্রিয় তরফদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

যাদবপুরের যে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগের জেরে ‘হোক কলরব’ আন্দোলন হয়েছিল, যে আন্দোলনের জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে পুলিশ ঢুকেছিল, পদত্যাগ করতে হয়েছিল উপাচার্যকে— এক বছর পরেও সেই ঘটনার তদন্ত রিপোর্টই জমা পড়েনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র-কর্মীরা জানেন না, কী আছে ওই রিপোর্টে।

কিন্তু শ্লীলতাহানির দ্রুত ও বিধিসম্মত তদন্ত চেয়েই তো এত আন্দোলন! তা হলে তদন্ত রিপোর্টের কী হল, তাই নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই কেন? ‘হোক কলরব’-এ অংশগ্রহণকারী অনেক ছাত্রছাত্রীই বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা ফেটসু-র চেয়ারম্যান শুভব্রত দত্তের দাবি, যে কমিটি এই তদন্ত করেছে সেখানে কোনও ছাত্র প্রতিনিধি ছিল না। তাই সেই কমিটির কোনও মান্যতা তাঁরা স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দাবি বিশাখা গাইডলাইন মেনে, ‘জেন্ডার সেল’ তৈরি করে, সেই সেল-এ ছাত্র প্রতিনিধি রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন করে তদন্ত হোক।’’ গত বছর ‘হোক কলরব’-এর আর এক মুখ গীতশ্রী রায়েরও প্রশ্ন, ‘‘ছাত্র প্রতিনিধি ছাড়া ওই তদন্ত রিপোর্টের কোনও বৈধতা আছে কি?’’

তা হলে এক বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে তাঁরা চুপচাপ কেন? শুভব্রতর ব্যাখ্যা, ‘‘আগের বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবি মানতে চাননি। নতুন উপাচার্য আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চেয়েছেন। আমরা ওঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ে ফের আমাদের দাবি তুলব।’’ গীতশ্রী বলছেন, ‘‘আন্দোলন থামার কোনও প্রশ্ন নেই। আমরা নতুন উপাচার্যকেও এ বিষয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি।’’ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই জানাচ্ছেন, অভিজিৎ চক্রবর্তী সরে যাওয়ার পরে ওই শ্লীলতাহানির ঘটনা নিয়ে সে ভাবে আর কোনও আন্দোলন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেননি। গত বছর ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় । শ্লীলতাহানির তদন্ত রিপোর্ট সামনে আসেনি জেনে তিনি বলেন, ‘‘যে ঘটনার জন্য আন্দোলন, সেই তদন্তের রিপোর্ট নিয়ে ছাত্রদের মাথাব্যথা না থাকলে সমাজের কাছে খারাপ বার্তা যায়। উপাচার্য পদত্যাগ করার পরেই আন্দোলন থেমে যাওয়াটা মানুষ কিন্তু অন্য ভাবে নিচ্ছে!’’

ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন সমর্থন করেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটা-ও। জুটা এ বিষয়ে কী বলছে? সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নীলাঞ্জনা গুপ্ত বলেন, ‘‘নতুন উপাচার্যের কাছে শুক্রবারই আমরা এ বিষয়ে জানিয়ে এসেছি। রিপোর্ট কী হয়েছে জানি না।’’ তদন্ত রিপোর্ট কেন পেশ হয়নি, প্রশ্ন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বলেন, ‘‘আমি সবে এসেছি। এ বিষয়ে কিছুই জানি না। খতিয়ে দেখছি।’’ গত ১৪ জানুয়ারি উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী পদত্যাগ করার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে কাজ চালিয়েছেন সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) আশিস বর্মা। এত দিনেও তদন্ত রিপোর্ট কর্মসমিতিতে পেশ হয়নি কেন? আশিসবাবুর দাবি, ‘‘রিপোর্ট তো পেশ হয়ে গিয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ মেনে পদক্ষেপ করা হয়েছে।’’ অথচ কর্মসমিতিরই এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘তদন্ত রিপোর্ট ২০১৪-র ডিসেম্বরে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন উপাচার্য অভিজিৎবাবুর কাছে তা পেশ করা হয়। কিন্তু তার পর সেই রিপোর্ট কোথায় গিয়েছে, কারও জানা নেই।’’ আর এক সদস্যের দাবি, ‘‘গত ৩ মার্চ ফের কর্মসমিতির বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ওই তদন্ত রিপোর্ট পেশের বিষয়টির উল্লেখ ছিল। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য আমাদের বলেন, প্রথমে অভিযোগকারিণীকে রিপোর্ট পড়ে শোনানো হবে। তার পরে সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা অন্ধকারে।’’ তা হলে কীসের ভিত্তিতে পদক্ষেপ করলেন আশিসবাবু? রিপোর্ট কি আদৌ কর্মসমিতির কাছে পেশ করা হয়েছিল? আশিসবাবুর দাবি, ‘‘কর্মসমিতিতে ওই রিপোর্ট পেশ করবার নিয়ম নেই।’’ তা হলে সেই রিপোর্ট কোথায় গেল? কী পদক্ষেপ করা হল? আশিসবাবুর জবাব, ‘‘এ সব গোপন ব্যাপার। আপনাকে বলব কেন?’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘উপাচার্য হিসেবে আমার কিছু ক্ষমতা ছিল। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি। কী করেছি কাউকে বলতে বাধ্য নই।’’

কিন্তু কর্মসমিতিকে এড়িয়ে এ ধরনের রিপোর্ট নিয়ে কি কোনও পদক্ষেপ করতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু কিন্তু বলছেন, ‘‘কর্মসমিতিকে এড়িয়ে কোনও রিপোর্ট পেশ করা সম্ভব নয়। অন্তত নিয়ম তাই বলে। উনি (আশিসবাবু) কেন এ রকম বলছেন জানি না।’’ শিক্ষক সংগঠন আবুটা-র যাদবপুর শাখার আহ্বায়ক গৌতম মাইতির অভিযোগ, ‘‘কর্মসমিতিতে রিপোর্ট পেশ না করার যুক্তি আইনের ধোপে টেকে না। আসলে রিপোর্ট চাপা দিয়ে কাউকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে।’’ আনন্দদেববাবুও বলছেন, ‘‘যদি কর্মসমিতিকে এড়িয়ে গিয়ে রিপোর্ট পেশ করা হয়ে থাকে তবে তা আইনানুগ হয়নি।’’ ২০১৪-র ২৮ অগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি হয় বলে অভিযোগ ওঠে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অভিজিৎ চক্রবর্তী। ছাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি ওই অভিযোগের তদন্তভার দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্টারনাল কমপ্লেন কমিটি’ (আইসিসি)-কে। কর্মসমিতির একাধিক সদস্যের মতে, নিয়ম মোতাবেক তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রথমে কর্মসমিতিতেই পেশ করার কথা। এমনকী অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে কর্মসমিতি। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট না পেলে কিছু করা সম্ভব নয়।

অভিযোগকারিণী নিজে কি তদন্ত রিপোর্টের কথা জানেন? তাঁর অভিযোগকে কেন্দ্র করেই যথাযথ তদন্ত এবং দোষীদের অবিলম্বে শাস্তির দাবিতে উত্তাল হয়েছিল যাদবপুর ক্যাম্পাস। ছাত্রদের উপরে পুলিশি নিগ্রহের প্রতিবাদে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। পরিস্থিতি সামলাতে অভিযোগকারিণীর বাড়ি গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস দিয়ে এসেছিলেন। ওই ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, মে মাসে তাঁকে তদন্ত রিপোর্ট দেখানো হয়েছিল। রিপোর্টে তাঁর অভিযোগের সত্যতা ‘প্রমাণিত’ হয়েছে। তা হলে দোষীদের শাস্তি চাইছেন না কেন? ছাত্রীর উত্তর, ‘‘এখনও এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে মুখ খুলতে বারণ করেছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE