মধ্যমগ্রামের এটিএম কাউন্টার সিল করে দিল পুলিশ। — নিজস্ব চিত্র
কোনও ফেলুদার ডাক পড়বে কি না, এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আপাতত নতুন এক বাক্স-রহস্য ভেদ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন ইউকো ব্যাঙ্কের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অফিসার ও পুলিশ। বিশেষ যে-বাক্সটি এই রহস্যের কেন্দ্রে, সেটি আসলে একটি এটিএম মেশিন। তদন্তের প্রয়োজনেই মঙ্গলবার সকালে ওই এটিএমে গ্রাহকদের ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
রহস্যের সূত্রপাত শনিবার রাতে। তদন্তকারীরা জানান, শনিবার রাত থেকে রবিবার রাত পর্যন্ত মধ্যমগ্রামের অন্তত ১০ জন গ্রাহকের মোবাইলে এসএমএস আসে, এটিএম থেকে তাঁদের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ওই ১০ জনের বেশির ভাগই ইউকো ব্যাঙ্কের মধ্যমগ্রাম শাখার গ্রাহক। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন এসবিআই এবং সিটি ব্যাঙ্কের কিছু গ্রাহকও। দফায় দফায় তাঁদের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে কলকাতার বিভিন্ন এলাকার এটিএম থেকে।
হতভম্ব করে দেওয়া এই কাণ্ডের কথা জানিয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা সোমবার মধ্যমগ্রাম থানার দ্বারস্থ হন। বিষয়টি জানানো হয় ইউকো ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষকেও। তদন্তে নেমে জানা যায়, ওই সব গ্রাহক গত এক সপ্তাহের মধ্যে কোনও না কোনও সময়ে মধ্যমগ্রাম ইউকো ব্যাঙ্কের লাগোয়া এটিএম থেকে টাকা তুলেছিলেন। এসবিআই এবং সিটি ব্যাঙ্কের যে-সব গ্রাহকের টাকা গায়েব হয়েছে, তাঁরাও ওই সময়ের মধ্যে এটিএম ব্যবহার করেছিলেন। এর থেকেই তদন্তকারীদের ধারণা, রহস্যের যাবতীয় সূত্র লুকিয়ে রয়েছে এটিএম মেশিনের মধ্যেই। পুলিশের এক অফিসার এ দিন বলেন, ‘‘সব তদন্তের কেন্দ্রে এখন ওই যন্ত্রটিই। তাই এর সূত্র ধরেই অপরাধীদের কাছে পৌঁছতে হবে।’’
ওই অপরাধ ঠিক কী ভাবে ঘটানো হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা?
তদন্তকারীরা জানান, ওই এটিএমে গোপন ক্যামেরা রেখে গ্রাহকদের এটিএম কার্ডের নম্বর বা পিন নম্বর জেনে নেওয়া হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়াও এটিএম মেশিনে যেখানে কার্ড পাঞ্চ করা হয়, সেখানে নকল ‘কার্ড রিডার’ রেখে গ্রাহকদের কার্ডের তথ্য জেনে নেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এর পাশাপাশি ওই যন্ত্রে কার্ডের মাধ্যমে ভাইরাস ঢুকিয়েও গ্রাহকদের তথ্য চুরি করা যেতে পারে বলে জানান তদন্তকারীরা। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী মঙ্গলবার বলেন, ‘‘অভিযোগ মোতাবেক তদন্ত চলছে। সমস্ত সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
বসে নেই সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষও। পুলিশের পাশাপাশি ইউকো ব্যাঙ্কের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অফিসারেরাও তদন্ত শুরু করেছে বলে জানান ওই ব্যাঙ্কের এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর জে কে গর্গ। এ দিন তদন্তকারীরা ইউকো ব্যাঙ্কের ওই এটিএমের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেছেন। এটিএমে কর্মরত রক্ষীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রতারিত গ্রাহকদের সমস্ত নথিপত্র সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা। তাঁরা জানান, প্রতারিতদের মোবাইলে আসা এসএমএসের সূত্র ধরে যে-সব এটিএম থেকে টাকা তোলা হয়েছে, সেগুলির সিসিটিভি ফুটেজও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইউকো ব্যাঙ্কের জেনারেল ম্যানেজার (তথ্যপ্রযুক্তি) অতুল সিংহ জানান, প্রতারিতদের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এই অপরাধের কিনারা করতে না-পারলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে বলে ব্যাঙ্ককর্তাদের আশঙ্কা এবং সেটা তাঁরা জানিয়েও দিচ্ছেন।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, যে-ভাবেই এটিএম থেকে টাকা হাতানো হোক না কেন, অপরাধীরা সেটা করেছে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েই। অপরাধীরা সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের সব তথ্য নিয়ে হুবহু নকল কার্ড (‘ক্লোন’) তৈরি করে তা দিয়ে বিভিন্ন এটিএমে ঢুকে টাকা তুলে নিয়েছে। তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, যারা এত আট ঘাট বেঁধে নেমেছে, এটিএমের সিসিটিভি-র ফুটেজে তাদের ছবি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে এই সময়ে শীতবস্ত্রে মুখ ঢেকে এটিএম ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, গ্রাহকেরা যে-টাকা খোয়ালেন তার দায় কে নেবে? খোয়ানো টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি? অর্থাৎ ব্যাঙ্কের উপরে ভরসা রেখে যাঁরা টাকা খোয়ালেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণের কী হবে?
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক কর্তার বক্তব্য, এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তার দায় গ্রাহকদের নয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে, এ-সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ককেই দায় নিতে হবে। ইউকো ব্যাঙ্কের তরফেও মঙ্গলবার জানানো হয়েছে, তদন্তে তাদের গাফিলতি প্রমাণিত হলে প্রতারিত গ্রাহকদের সব টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। প্রতারিতদের মধ্যে বৃদ্ধা সুতপা মুখোপাধ্যায়ের ছেলে রুদ্রদীপ এ দিন বলেন, ‘‘আমরা এ দিন ব্যাঙ্কে গিয়ে সমস্ত নথিপত্র জমা দিয়েছি। ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছেন, আমাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy