E-Paper

পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হত মুর্শিদাবাদের সামিমদের

পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম জানাচ্ছেন, ভারতীয়ত্বের সব পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও নাজিমুদ্দিনদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা বিএসএফের সঙ্গে কথা বলার পরে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয় মুর্শিদাবাদের ওই বাসিন্দাদের।

মফিদুল ইসলাম , সারিউল ইসলাম

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৫ ০৬:৪৯
মায়ের সঙ্গে সামিম খান। হরিহরপাড়ায়।

মায়ের সঙ্গে সামিম খান। হরিহরপাড়ায়। ছবি: মফিদুল ইসলাম।

চায়ের দোকানে বসে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলায়। রাত আটটা হবে। হঠাৎই পুলিশ সেখানে গিয়ে দাবি করে, মরাঠিতে কথা বলতে হবে। তরতর করে মরাঠি বলতে না পারায় সঙ্গে সঙ্গে আটক। চার দিন একটা ঘরে আটকে রাখা হয়। গত ৯ জুন থেকে সেই ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এখনও কেঁপে উঠছেন সামিম খান, নাজিমুদ্দিন মণ্ডল। সামিম থাকেন মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ায়। নাজিমুদ্দিন তরতিপুর গ্রামে।

সামিম বলেন, ‘‘ছিলাম ঠাণের মীরা রোডে। আমরা ৯ জন বাঙালি। সেই রাতে পুলিশ মোবাইল ফোন কেড়ে নিল। আমার কাছে ছিল প্রায় ২০ হাজার ৩০০ টাকা, সেটাও নিয়ে নিল। ভোটার কার্ড আর যা কাগজপত্র ছিল, তা-ও নিল।’’ পাশ থেকে নাজিমুদ্দিন বলেন, ‘‘চার দিন অসহ্য কষ্টে গিয়েছে। প্রথমে থানার লক আপে আটকে রাখা হয়। কথা বললেই জুটত চড়, থাপ্পড়। দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে হাত বেঁধে রাখা হত। তার পরে আর একটা জায়গায় নিয়ে যায়, নাম জানি না। খেতে দিত কিন্তু তা খাওয়ার যোগ্য ছিল না। তার পরে আবার হাত বেঁধে পুণে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বাগডোগরা। তার পরে আবার মারধর করে কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আমাদের বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়। আমরা যেতে চাইনি, তখন বেধড়ক মারধর করা হয়।’’

পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান রাজ্যসভার সাংসদ সামিরুল ইসলাম জানাচ্ছেন, ভারতীয়ত্বের সব পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও নাজিমুদ্দিনদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা বিএসএফের সঙ্গে কথা বলার পরে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয় মুর্শিদাবাদের ওই বাসিন্দাদের। ১৭ জুন সামিম ও নাজিমুদ্দিন অবশেষে বাড়ি ফেরেন। অভিযোগ, একই পরিণতি হয়েছিল ভগবানগোলার মহিষস্থলীর মেহবুব শেখেরও। সামিরুল বলেন, ‘‘কোচবিহার সীমান্ত দিয়েমেহবুবকে মারধর করে বিএসএফ ঢুকিয়ে দেয় বাংলাদেশে। পরে তাঁকে উদ্ধার করা হয়েছে।’’

নাজিমুদ্দিনের মা ও স্ত্রী। হরিহরপাড়ার তরতিপুরে।

নাজিমুদ্দিনের মা ও স্ত্রী। হরিহরপাড়ার তরতিপুরে। ছবি: মফিদুল ইসলাম।

রাজমিস্ত্রির কাজ করতে চার-পাঁচ বছর ধরে সামিমেরা মুম্বই যাচ্ছেন। এ বারই এমন হল কেন? সামিমের ধারণা, এপ্রিলে শমসেরগঞ্জে অশান্তি এবং রক্তক্ষয়ের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় গোলমাল শুরু হয়েছে। হরিহরপাড়ার বিধায়ক তৃণমূলের নিয়ামত শেখও বলেন, ‘‘শমসেরগঞ্জের ঘটনা ভুল ধারণা ছড়িয়ে গিয়েছে। তারই ফল ভুগছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা।’’

সামিম, নাজিমুদ্দিনদের রোজগারেই তাঁদের সংসার চলে। বিকল্প রোজগার নেই। বাড়িতে স্ত্রী, মা ও সন্তানেরা থাকেন। নিজের টিনের বাড়ির দাওয়ায় বসে সামিম বলেন, “বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি, আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। তবুও থানার লক আপে আটকে রেখেছিল। প্রচণ্ড মারধর করা হয়। সব কিছু কেড়ে মারধর করে আমাদের কাঁটাতারের গেট খুলে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। দু’দিন দু’রাত লুকিয়ে থাকার পরে এক রাতে কয়েককিলোমিটার হেঁটে কোনও মতে ভারতের উত্তর দিনাজপুরে ফিরি। থানায় গিয়ে সব কথা বলি। তার পরে ঘরে ফিরতে পেরেছি।’’ নাজিমুদ্দিন-সহ কয়েক জনকে বিএসএফই কোচবিহার সীমান্ত দিয়ে ফিরিয়ে নেয়। নাজিমুদ্দিনও বলেন, ‘‘বাড়ি যে ফিরতে পারব, তাই ভাবিনি।’’

ওড়িশায় কাজে গিয়ে সেখানকার পুলিশের হাতে ৩১ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত আটক ছিলেন তরতিপুরেরই সাইনুর শেখ, রাকিবুল শেখ ও হাসিবুল শেখ। তাঁরাও রাজমিস্ত্রির কাজ করতে ওড়িশা যাচ্ছেন ১০-১২ বছর ধরে। কেউ কাজ করতেন ঝাড়সুগুদার জেলার বাজগড়নগরে, কেউ জগৎসিংহপুর জেলার বালিকোদায়।

সাইনুর বলেন, “আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সেখানে হঠাৎ এক রাতে পুলিশ এল। আমাদের নথিপত্র দেখতে চাইল। তার পরে থানায় নিয়ে গেল। ছাড়ল না। থানার পাশেই অনুষ্ঠান বাড়ির মতো একটি বাড়িতে পুলিশের পাহারায় আমাদের আটকে রাখা হয়েছিল। মেঝেতে চাদর পেতে শুতে হত। তিন বেলা খেতে দিত। কিন্তু সেই তরকারি-ভাত এতই খারাপ যে গলা দিয়ে নামত না। প্রাণ বাঁচাতে খেয়ে নিয়েছি।’’

ফিরলেন কী ভাবে? সাইনুরের পরিবার হরিহরপাড়া থানার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওড়িশা পুলিশের কাছে আবার পরিচয়পত্র পাঠানো হয়। মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র বলেন, “আমরা এই ধরনের ঘটনা জানতে পারলেই দ্রুত নথিপত্র যাচাই করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।” শুধু তাই নয়, ওড়িশার মুখ্যসচিবকে চিঠি লেখেন এ রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ। তার পরে ছাড়া পান ওই শ্রমিকেরা।

সাইনুরের বাড়িতেও মূল রোজগার তাঁরই। আর মা এবং স্ত্রী-র তাঁতে সুতো জড়ানোর কাজ করে যতটুকু আয় হয়। বাবা আব্দুর রাজ্জাক এবং রাকিবুল শেখের স্ত্রী গত ৪ জুলাই কলকাতা হাই কোর্টে‘হেবিয়াস কর্পাস’ ধারায় মামলাও করেন। গত বৃহস্পতিবার ওই মামলা শোনেন বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং ঋতব্রত কুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চ। মুখ্যসচিব পদমর্যাদার আধিকারিকের মাধ্যমে ওড়িশা সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য জানার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এর পরে কী? এখানেই কাজের খোঁজ করবেন? সামিম বলেন, “এখানে রাজমিস্ত্রির কাজে মজুরি কম। সংসার চালাতে মুম্বই না গিয়ে অন্য কোথাও যাব।” মা খতেজান বেওয়া পাশ থেকে বলে ওঠেন, “কাজ না করলেসংসার চলবে কী ভাবে? তবে মুম্বইয়ে আর যেতে দেব না। গেলে অন্য জায়গায় যাক।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Language Migrant Labours Murshidabad Thane

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy