কৃষ্ণনগরের হোমে এক আবাসিক। নিজস্ব চিত্র
রোজ রাতে সেই একটাই স্বপ্ন!
নিকনো উঠোনে বসে মা সব্জি কাটছেন। কাজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন বাবা। শীতের মিঠে রোদ্দুরে বসে দুলে দুলে মেয়েটা পড়ছে, ‘‘এ ফর অ্যাপল, বি ফর ব্যাট...।’’ হোঁচট খায় এইচ-এ এসে, ‘‘হোমের বাংলা কী বাবা?’’ মেয়ের প্রশ্ন শুনে হাসছেন বাবা, ‘‘সে কী রে! হোম মানে বাড়ি। যেখানে সবাই খুব আনন্দে থাকে। এই যেমন আমরা আছি।’’
ব্যস, এইটুকুই! রোজ রাতে স্বপ্নটা ঠিক এখানেই শেষ হয়ে যায়। তার রেশ থেকে যায় সকাল পর্যন্ত। আর চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই হাসি হাসি মুখটা! তারপর বাকি রাতটা কেমন ঘোরের মধ্যেই কেটে যায়। আরও একটি শীত-সকালে কৃষ্ণনগরের এক হোমের বছর উনিশের ওই তরুণী বলছেন, ‘‘আদিখ্যেতা করে সবাই এটাকেও যে কেন হোম বলে বুঝি না! জেলখানাও বোধহয় এর থেকে ভাল।’’
নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ, পড়শি দুই জেলায় সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় কুড়িটি হোম রয়েছে। গত কয়েক বছরে সেই হোমগুলো থেকে অন্তত ৬৪ জন পালিয়েছিলেন। সবাই কিন্তু ফিরে আসেননি। আর যাঁরা এসেছেন, তাঁরা বলছেন, ‘‘কেন পালাব না? এখানে কি মানুষ থাকতে পারে?’’
কোথাও দিনে একবার রান্না হয়। কোথাও আবাসিক পিছু খাবারের জন্য বরাদ্দ টাকা এতটাই কম যে পেট ভরে না কারও। কোনও হোমে টিভি থাকলেও চলে না, কোথাও আবার ঘরের জানলাগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে পুরু মশারি দিয়ে। ঠিক মতো আলো-বাতাস পর্যন্ত ঢুকতে পারে না।
‘নেই’ ও হোম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের এমন তালিকা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মুর্শিদাবাদের একটি হোমে সকাল সাড়ে ১১টার মধ্যে দুপুরের খাবার খাইয়ে মাথা গুণে ঘরের মধ্যে আবাসিকদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপর দরজার বাইরে তালা ঝুলিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন হোম কর্তৃপক্ষ। কোনও আবাসিক ঘরের মধ্যে ঢুকতে আপত্তি করলে মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ।
হোমের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মুখ গলিয়ে ভীরু গলায় এক আবাসিক বলছেন, ‘‘প্রতি মুহূর্তে দম বন্ধ হয়ে আসে। একবার পালিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু ফের ওরা ধরে আনল। বিশ্বাস করন, এ ভাবে থাকতে থাকতে একদিন মরেই যাব! সাধে কি আর সবাই পালাতে চায়!’’ আচমকাই কৃষ্ণনগরের ওই হোমের মধ্যে জোর হইচই। কী ব্যাপার?
বছর পঁচিশের এক মহিলা ততক্ষণে লোহার গ্রিলে মাথা ঢুকতে শুরু করেছেন, ‘‘ওরে, কেউ আমাকে একটু বাড়িতে পৌঁছে দিবি রে? ছেলের কাছে যাব।” অন্য আবাসিকরা ততক্ষণে ভয়ে কাঠ হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এ বার ওই মহিলা তেড়ে গেলেন অন্য আবাসিকদের দিকে। ওই মহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন। একটু দূরে আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁর মতো আরও এক তরুণী।
তাঁদের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে অন্য আবাসিকেরা বলছেন, ‘‘মানসিক ভারসাম্যহীনদেরও গুঁতিয়ে এখানে ঢোকানো হচ্ছে। এ ভাবে কি ওদের সঙ্গে থাকা যায়?” নিম্ন মানের খাবার খেয়ে, শীতে লেপ-কম্বল কিংবা গরম পোশাক না পেয়ে, স্যাঁতসেতে ঘুপচি ঘরে অপরিচ্ছন্ন বিছানাপত্র আর দুর্গন্ধকে নিত্যসঙ্গী করে যাঁরা এখনও টিকে রয়েছেন, তাঁরাও মুক্তি চান। সাবিনা, রূপা, সুলেখাদের (নাম পরিবর্তিত) সৌজন্যে তাঁদের অনেকেই খোঁজ পেয়ে যান একটি অন্য জীবনের। সেখানে নাকি সব স্বপ্ন পূরণ হয়।
সেই স্বপ্নের টানে একদিন হোমের পাঁচিল ডিঙিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় কতগুলো ছায়ামূর্তি। তারপর?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy