গাঁয়ের ছোট্ট বাজার। একপাশে আদ্যিকালের অশ্বত্থ গাছটার নীচে বাঁধানো লাল বেদির রং ক্ষয়ে ক্ষয়ে ধূসর। সেখানেই সকাল-বিকেল জমিয়ে বসতেন গাঁয়ের প্রবীণেরা। বয়স ও অভিজ্ঞতার নিরিখে তাঁদের কথাই মান্য করতেন সকলে। হুঁকোয় লম্বা টান মেরে, ঘাড় নেড়ে, উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডায় তাঁরাই বিচার করতেন। সঠিক-বেঠিক নির্ণয়ে তাঁরাই শেষ কথা। চিহ্নিত করতেন দোষীকে। দূর-দূরান্তের গ্রামাঞ্চলে তাঁরাই ছিলেন একাধারে আইন, আদালত ও পুলিশ।
সালিশি সভার সেই চেনা ছবিটা কিছুটা ফিকে হয়ে গেলেও তার দাঁত, নখ এখনও অক্ষত। এখনও গ্রাম্য বিবাদ থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সম্পর্কের টানাপড়েনের চৌহদ্দিতে তার দাপট রয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গাতেই নিদানদানকারীদের চরিত্র বদলেছে। গ্রামের লোকজন বলছেন, ‘‘তাঁরা আর শুধু গ্রামীণ প্রবীণ নন। তাঁরা দাদা। আর এ দাদা যে আলাদা, সে কথা তো সবাই জানে। সালিশি সভাতেই চলে তাঁদের দাদাগিরি। হুঁকোর বদলে তাঁদের হাতে জ্বলে দামী সিগারেট। তাঁদের মুখের উপরে কথা বলার সাহস নেই কারও।’’
অভিযোগ, এ ভাবেই রাজনীতির ‘দাদা’রা নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে গাঁ-গঞ্জের মানুষের সামাজিক জীবন। প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে একেবারে হেঁশেল পর্যন্ত। এঁদের কথা না-শুনলে পুলিশও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। এঁরা যে নিদান দেন তা অমান্য করলে রাজনৈতিক দলের কোপে পড়তে হয় বলে অভিযোগ।
এমনই এক সালিশি সভার সাক্ষী থেকেছিলেন নদিয়ার হাঁসখালির মানুষ। বেশ কয়েক বিঘা জমি তিন বছরের জন্য লিজ দেন সেখানকার এক ব্যক্তি। লিজ নেন শাসক দলের এক শিক্ষক নেতা। কিন্তু সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও জমি ছাড়তে রাজি হননি তিনি। ময়দানে নেমে পড়েন রাজনৈতিক দাদারা। ঠিক হয়, গ্রামের সালিশি সভায় সমস্যার মীমাংশা হবে। ‘দাদা’রা নিদান দেন, আরও কয়েক মাস জমির দখল থাকবে শিক্ষক নেতার হাতে। পরিবর্তে জমির মালিক পাবেন ২০ হাজার টাকা।
“এত অল্প টাকা?” প্রতিবাদ করেন জমির মালিক। কিন্তু তাঁর হয়ে বলার মতো আর কাউকে পাননি তিনি। অভিযোগ, সালিশি সভা থাবা বসিয়েছে ভোটের ময়দানেও। ভোটের আগে শাসক দলের কর্মীদের কথা অমান্য করায় মার খেয়েছিলেন নদিয়ার এক ব্যবসায়ী।
অবশেষে এক রাজনৈতিক নেতার বাড়িতে সভা বসে। তাঁর রায়, ‘‘পুলিশের দরকার কী? ভুলে যাও।’’ চাপের মুখে তা ভুলতেও বাধ্য হয়েছেন সেই ব্যবসায়ী। (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy