Advertisement
E-Paper

কুকারের কথা মনে পড়লে প্রেশার বাড়ে

জাতে সে চুরির সোদর ভাই। লোক ঠকানো বুদ্ধি, হাতের গুণ আর ওস্তাদের আশীর্বাদ— তিনের মিশেল হলে যখন তখন মাহেন্দ্রক্ষণ! কেপমারিকে প্রায় আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে, এমনই কয়েক জন দিকপালের খোঁজ নিল আনন্দবাজারজাতে সে চুরির সোদর ভাই। লোক ঠকানো বুদ্ধি, হাতের গুণ আর ওস্তাদের আশীর্বাদ— তিনের মিশেল হলে যখন তখন মাহেন্দ্রক্ষণ! কেপমারিকে প্রায় আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে, এমনই কয়েক জন দিকপালের খোঁজ নিল আনন্দবাজার

সুজাউদ্দিন

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৫০
অঙ্কন: মণীশ মৈত্র।

অঙ্কন: মণীশ মৈত্র।

এমনই এক শীত ফুরনো সকাল।

খেতের আলপথ ছেড়ে সাইকেল উঠল পিচ রাস্তায়। নতুন সাইকেল। নানি কিনে দিয়েছে।

গন্তব্য হরিহরপাড়া, খালার বাড়ি। দুপুরে সেখানে জমিয়ে খাওয়াদাওয়া। সন্ধ্যায় সাইকেল উজিয়ে নিজের বাড়ি, শীতলনগর।

দু’পাশে সরে যাচ্ছে গাছগাছালি। চুলে বিলি কাটছে মনকেমন করা হাওয়া। কোনও ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ নেই। বারবার চেন পড়ে যাওয়া নেই। সাইকেল তো নয়, যেন পক্ষীরাজ!

প্যাডেলে মোক্ষম একটা চাপ দিয়ে গান ধরেছিলেন বছর পঁচিশের আলাউদ্দিন মালিথ্যা। কিন্তু সে গান মাঝপথেই থেমে গেল। থামাতে হল সাইকেলও। গাবতলার কাছে পথ আটকে দাঁড়িয়ে একটি লোক, বয়স মেরেকেটে মাঝ-তিরিশ। হাতে ঝুলছে মিষ্টির হাঁড়ি। গলাটাও বড় মিঠে।

লোকটি বলল, ‘‘ভাইটি, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। গাড়ির দেখা নেই। এই সামনে, ভগীরথপুর পর্যন্ত যাব। তুমি যদি একটু...।’’

না করতে পারেননি আলাউদ্দিন। কিন্তু শর্ত একটাই, তিনি ডাবল ক্যারি করতে পারবেন না। সাইকেল চালাতে হবে লোকটিকেই। লোকটির আদৌ তাতে আপত্তি নেই, ‘‘এটা কেমন কথা হল ভাইটি! আমি থাকতে তুমি কেন সাইকেল ঠেলবে! হাঁড়িটা ধরে তুমি জুত করে বোসো দেখি।’’

সাইকেলের সামনে রডে বসলেন আলাউদ্দিন। ফের ছুটল সাইকেল। কত কথা, কত গল্প। যেন কত দিনের চেনা। কিন্তু মাইলখানেক যাওয়ার পরেই— ঘ্যাঁচ! সাইকেল থেমে গেল। চমকে উঠে আলাউদ্দিন বললেন, ‘‘কী হল দাদা?’’

প্রশ্ন চাপা পড়ে গেল লোকটার হাহাকারে, ‘‘যাঃ, আমার ব্যাগটা? সে তো গাবতলায় পড়ে! সেখানে অনেক টাকা আছে ভাইটি।’’ আলাউদ্দিনও ভ্যাবাচাকা। ফের লোকটি শুরু করে, ‘‘তুমি মিষ্টির হাঁড়িটা নিয়ে একটুক্ষণ দাঁড়াও। আমি যাব আর আসব।’’

ধু-ধু পথে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন আলাউদ্দিন। এক ঘণ্টা, দু’ ঘণ্টা....। কত শিমুল ঝরে পড়ল। কত পলাশ উড়ে এল গায়ে। লোকটি আর ফিরল না।

ফেরেনি সেই লোকটাও!

তবে এ বার আর সাইকেল নয়, আস্ত একটা বাইক।

ডোমকলে লেপ-তোষকের পুরনো দোকান মির আলির। মুখের কথায় কারবার, বেশি রসিদ-টসিদের ধার ধারেন না তিনি। ব্যবসা চলে বিশ্বাসে, এটাই তাঁর স্থির বিশ্বাস।

তো, গেল বছর শীত সবে আসব-আসব করছে, এক ছোকরা দোকানে এসে হাজির। তার বোনের বিয়ে। ফুল সেট লেপ-তোষক হবে। খরচাপাতি নিয়ে কোনও কার্পণ্য নেই। দেখেশুনে ভাল কাপড় বেছেও ফেলল সে। ফট করে অ্যাডভান্স করে দিল পাঁচশো টাকা (তখনও নোট বাতিল হয়নি)।

তা বাপু, মাপটা কী হবে? তোষক কি ছয় বাই সাত খাটের জন্য? আর লেপ আড়ে‌-বহরে কত? শুনে পকেট হাতড়ে ছেলের মাথায় হাত! মাপের কাগজটাই তো বাড়িতে পড়ে! ‘‘ওই যে বাইরে বাইক রাখা, আপনাদের নাকি? দেবেন এক বার? ধাঁ করে নিয়ে আসব।’’ এক মুহূর্ত থমকেছিলেন মির আলি। তার পরেই মনে হল, কারবার করে চুল-দাড়ি পাকিয়ে ফেললেন, অ্যাডভান্স করে পালায়, এমন খদ্দের জম্মে দেখেননি। ড্রয়ার থেকে বের করে বাড়িয়ে দিলেন বাইকের চাবি।

ছেলেটি গেল। আর ফিরল না।

ডোমকলেই নাম করা মনোহারির দোকান সবুজ মণ্ডলের। দুপুরে ভিড় ছিল বেশ। কিছু কর্মচারী খেতে চলে গিয়েছেন। ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন সবুজ।

ঠিক সেই সময়ে দোকানে ঢুকে একটি ছেলে জানতে চাইল, ‘‘প্রেশার কুকার দেখাবেন, দাদা?’’ ভিড়ের মধ্যেই সবুজ তাকে গোটা কয়েক প্রেশার কুকার নামিয়ে দিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পরে যুবকটি বলে উঠল, ‘এই দু’টোর মধ্যেই একটা নেব। কিন্তু কোনটা নেব বুঝতে পারছি না। ওই যে দেখছেন, বাইরে বসে, উনি আমার গিন্নি। ওঁকে একটু দেখিয়ে আনি?’’

সবুজ উঁকি মেরে দেখেন, তাঁর দোকানের সামনে গাছের ছায়ায় শিশু কোলে এক মহিলা বসে। তিনি আর না করেন কী করে? তাই তো, কুকারে রান্না তো করবেন বাড়ির গিন্নি। তাঁকে তো দেখিয়ে নেওয়াই ভাল। তিনি আছেনও কাছাকাছি। এর পরে তাঁকে না দেখিয়ে কেউ কুকার কেনে নাকি!

মিনিট খানেক অন্য খদ্দেরের দিকে নজর দিয়েছিলেন সবুজ। তার পরে ফিরে দেখেন, মহিলাটি তখনও বসে। কিন্তু আশপাশে তাঁর স্বামীর দেখা নেই, প্রেশার কুকারও নেই। সন্দেহ হয় সবুজের। দোকান অন্য এক জনের জিম্মায় ছেড়ে তিনি এগিয়ে যান মহিলার কাছে।

—আমার প্রেশার কুকার দু’টো গেল কোথায়?

—তা আমি কী করে বলব?

—মানে? তোমার স্বামী কোথায়?

—সে তো কেরলে!

সবুজ হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গুটি-গুটি পায়ে দোকানে ফিরে আসেন। ততক্ষণে যা বোঝার তিনি বুঝে গিয়েছেন।

বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া প্রেশার কুকার দু’টোর কথা ভাবলেই আজও সবুজের ব্লাডপ্রেশার একটু চড়ে যায়!

Pickpocketer
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy