E-Paper

শৌচালয়েই পাঠশালা মা-মেয়ের

মঙ্গলবার দুপুরে দেখা গেল শৌচালয়ের কাউন্টারে খুচরো পয়সার হিসেব রাখার কাজের ফাঁকেই মেয়েকে পড়াচ্ছেন মা।

সুদেব দাস

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ ০৮:০৪
শৌচালয়ের ছোট্ট ঘরে মেয়েকে পড়াচ্ছেন মা। রানাঘাটে।

শৌচালয়ের ছোট্ট ঘরে মেয়েকে পড়াচ্ছেন মা। রানাঘাটে। নিজস্ব চিত্র।

আদালত চত্বরে রয়েছে পুরসভার শৌচালয়। দিনের ব্যস্ততম সময়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মাঝেমধ্যেই সেখানে যাচ্ছেন আইনজীবী, মক্কেল কিংবা প্রশাসনিক কাজে মহকুমা শাসকের দফতরে আসা মানুষজন। শৌচালয়ের ভেতরেই রয়েছে ছোট্ট একটা ঘর। ভ্যাপসা গরমে মাথার উপর ঘুরছে পাখা। মেয়েকে পাশে বসিয়ে বইয়ের ছাপা অক্ষরে আঙুল রেখে মা পড়াচ্ছেন, ‘আমি যখন হাতে মেখে কালি, ঘরে ফিরি সাড়ে চারটে বাজে। কোদাল নিয়ে মাটি কোপায় মালি, বাবুদের ওই ফুলবাগানের মাঝে’।

শৌচালয়ের ওই ঘর যেন হয়ে উঠেছে বছর দশের সুহানীর সাউয়ের 'পাঠশালা'। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে রানাঘাট ব্রজবালা প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এই ছাত্রীর অধিকাংশ দিন কাটে রানাঘাট আদালতের পাশে থাকা ওই শৌচালয়ের ঘরে। মায়ের সঙ্গে। শিশুমন সেই ঘরে বসেই আনমনে সাদা কাগজে এঁকেছে ছবি। তাতে পড়েছে রঙের প্রলেপ। মেয়ের শখের আঁকা ছবি শৌচালয়ের ওই ঘরের দেওয়ালে সযত্নে ঝুলিয়ে রেখেছেন মা কল্পনা।

শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের থানাপাড়ার বাসিন্দা শংকর সাউ। রানাঘাট রেল বাজারে বিভিন্ন দোকানের ভারী বস্তা মাথায় বয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন তিনি। যেটুকু পারিশ্রমিক মেলে তা দিয়ে স্বামী-স্ত্রী ও দুই মেয়ের পেট কোনও মতে চলে। তাই কলেজ পড়ুয়া বড় মেয়ে স্নিগ্ধা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছোট মেয়ে সুহানীর পড়াশোনার খরচ জোগাতে শৌচালয়ে কাজ নিয়েছেন মা।

মঙ্গলবার দুপুরে দেখা গেল শৌচালয়ের কাউন্টারে খুচরো পয়সার হিসেব রাখার কাজের ফাঁকেই মেয়েকে পড়াচ্ছেন মা। কিন্তু শৌচালয়ে কেন? উত্তরে কল্পনা বলেন, ‘‘বড় মেয়ে চাকদহ কলেজে পড়ে। ও কলেজে যাওয়ার সময় বোনকে স্কুলে দিয়ে যায়। আজ বড় মেয়ের কলেজে যাওয়া হয়নি। তাই ছোট মেয়েও স্কুলে যেতে পারিনি।’’ মহিলার কথায়, ‘‘স্বামী, মেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়িতেই ঠাঁই হয়েছে। অভাবের সংসার। ছোট মেয়েকে কোথায় রেখে আসব ভেবে ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি।’’ খানিক থেমে কল্পনা বললেন, ‘‘এই যে দেখছেন বিভিন্ন ছবি আঁকা। সব মেয়ে এঁকেছে। ও আঁকা শিখতে চায়। কিন্তু সেই ক্ষমতা যে আমাদের নেই।’’ আর ছোট্ট সুহানীর বক্তব্য, ‘‘মায়ের কাছে সারা দিন বই নিয়ে পড়তে ভাল লাগে।’’

জানা গিয়েছে, প্রতিদিন ওই শৌচালয়ের জন্য ১২০ টাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য আলাদা করে রাখতে হয় কল্পনাকে। তার পর যেটুকু থাকে, তা নিয়েই ঘরে ফেরেন মহিলা। আবার আদালত বন্ধ থাকলে উপার্জনে ভাটা পড়ে। মায়ের মুখ কালো হয়। তা অবশ্য বোঝার বয়স হয়নি ছোট্ট মেয়েটার। মায়ের স্নেহের আঁচলে কপালের ঘাম মুছে সে বলে, ‘ইচ্ছে করে, আমি হতেম যদি/ বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মালি’। তার পরের লাইনটা কী হবে মা? মা বলেন, ‘একটু বেশি রাত না হতে হতে/ মা আমারে ঘুম পাড়াতে চায়, জানলা দিয়ে দেখি, যে পথে পাগড়ি পড়ে পাহারওয়ালা যায়’। মা-মেয়ের পাঠশালায় মাঝে হঠাৎ ছন্দপতন, ‘‘দিদি ১০ টাকা খুচরো হবে তো?’’

বর্তমানে প্রায় ৪০ বর্গফুটের শৌচালয়ের এই ঘর যেন কল্পনার কাছে সংসার হয়ে উঠেছে। এক দিকে, উপার্জন। অন্য দিকে, মেয়েকে মানুষ করে তোলার লড়াই। তাঁর এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছেন ব্রজবালা প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাজীবকুমার বসু। রানাঘাটের পুরপ্রধান কোশলদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিষয়টি প্রথম আমার নজরে এল। ওই ছাত্রীর পড়াশোনা, সব রকম সাহায্যের জন্য পাশে রয়েছি।’’

পড়ন্ত বিকেল। ক্রমশ ফাঁকা হচ্ছে আদালত চত্বর। বইয়ের ব্যাগ পিঠে তুলে মায়ের হাত ধরে বাড়ির পথে চলেছে মেয়ে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ranaghat

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy