স্মৃতির আবার কখনও বয়স বাড়ে নাকি!
প্রতি বছর বছর চৈত্র সংক্রান্তির সকালে বছর চুয়াত্তরের কনক দাস তাই ভাসতে থাকেন সবুজ স্মৃতিতে। মনে মনে তিনি পৌঁছে যান দেশ-কালের সীমা ছাড়িয়ে বহু দূরে।
ঢাকার বর্ধিষ্ণু গ্রাম কলাকোপা। সংক্রান্তির ভোরে নববর্ষের উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। ভৈরব কিংবা কীর্তিনাশায় স্নান সেরে নতুন পোশাক পরে কনকও বাড়ির সকলের সঙ্গে হাজির ঠাকুরঘরে। তখন তো এত মঠ-মন্দির ছিল না। তাই যে কোনও উৎসবে গৃহদেবতার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ঠাকুরঘরে প্রদীপ, ধূপ জ্বালিয়ে ভাইয়ের হাতে তিনি তুলে দেন যবের ছাতু।
বাড়ির প্রত্যেক সদস্যকে সে দিন যবের ছাতু খেতেই হবে। বছরের শেষ বিকেলটাও ভারী মজার। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কুলোর বাতাসে ছাতু ওড়ানোর সময়। মেয়েরা সুর করে ছড়া কাটছেন, ‘শত্রুর মুখে দিয়া ছাই, ছাতু উড়াইয়া ঘরে যাই’। চৈত্রের শুকনো বাতাসে মেঠো পথের ধুলো আর ছাতু মিলেমিশে একাকার। এর পরেই শুরু হতো নদীর জলে একে অপরকে ভিজিয়ে দেওয়ার খেলা। বছরের শেষ সূর্যকে সাক্ষী রেখে সেই খেলা চলত
সন্ধ্যা পর্যন্ত।
এ ভাবেই বাংলা পঞ্জিকার শেষ দিনে নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত ওপার বাংলায়। ১৩৭০ সনে বাপ-কাকার হাত ধরে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন কনক। কলাকোপা গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারের মেয়ে কনক তখন সবে আঠেরোয় পা দিয়েছেন। তাঁর এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেই নববর্ষের কথা। তিনি বলছেন, ‘‘চৈত্র সংক্রান্তিকে আমার বলতাম ছাতু সংক্রান্তি। সে দিনের অনুষ্ঠান ছিল অনেকটা ভাইফোঁটার মতো। ভাইয়ের হাতে ছাতু দেওয়ার ওই অনুষ্ঠানকে বলা হত ভাই-ছাতু।’’
এপার-ওপার দুই বাংলা জুড়েই চৈত্র সংক্রান্তির হরেক নাম। পঞ্জিকাতে এই দিনটি মহাবিষুব নামে চিহ্নিত। বাকি নামগুলির সঙ্গে একটা করে উৎসবের ছোঁয়া থেকে গিয়েছে। কোথাও পাঁচকুমার, কোথাও ফলগছানো, কোথাও এয়ো সংক্রান্তি, কোথাও আবার মধু সংক্রান্তি। নানা ব্রত-পার্বণের মধ্যে দিয়ে বছরের শেষ দিন থেকেই নতুন বছরের উৎসবের সুরটা বেঁধে দেওয়া হত। সকালে ব্রতপালনের পরে দুপুরে একটা জমজমাট খাওয়াদাওয়া ছিল সে উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। ঘরের তৈরি নানা খাবার এবং মিষ্টান্নের রকমারি আয়োজনে নতুন বছরকে অভ্যর্থনার প্রস্তুতি আগাম সারা হয়ে যেত। কনক বলছেন, ‘‘মা-ঠাকুমারা অতি সাধারণ যবের ছাতুর সঙ্গে দই-নুন-চিনি কিংবা ছাতুর সঙ্গে শুধু দুধ, ক্ষীর বা অন্য মিষ্টি দিয়ে অসাধারণ সব পদ তৈরি করতেন। এখন তো লাড্ডুর দিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে সব খাবার কোথায় হারিয়ে গেল!”
খুলনা আর যশোরের সীমানায় বর্ধিষ্ণু গ্রাম সিদ্ধিপাশায় সেকালে নববর্ষ আসত একটু অন্য ভাবে। গ্রামের প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠবিহারী কর। সেই সময় তাঁদের ঘরে তৈরি কাপড়ের জন্য হাওড়া-মঙ্গলাহাটের বিক্রেতারা হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতেন। একান্নবর্তী কর পরিবারে প্রতিদিনই তিরিশটা করে পাত পড়ত দু’বেলা। গ্রামের বেশিরভাগ তাঁতিই গোষ্ঠবিহারীর কাপড় বুনতেন। ফলে বাংলা নববর্ষে গোষ্ঠবিহারীর হালখাতার উৎসব ছিল দেখার মতো। গোষ্ঠবিহারীর ছোট মেয়ে বীণাপাণি নন্দী এখন পঁচাশি। তাঁর স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল সেই সময়ের নববর্ষ। তিনি বলছেন, ‘‘সকালে মিহি ধুতি পরে বাবা বসতেন পুরোহিতের পাশে। গণেশ পুজোর শেষে লাল কাপড়ে জড়ানো হালখাতায় সিঁদুর মাখানো টাকার ছাপ দেওয়া হত। সে সব কি আর ভোলা যায়!’’
স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন বীণাপাণি, ‘‘আমাদের বাড়ি ছিল ভৈরবের পাড়ে। প্রতিদিনই আমরা নদীতে স্নান করতাম। কিন্তু পয়লা বৈশাখের সকালে বাড়ির সবাই মিলে খুব ভোরে স্নানের মজাটাই ছিল অন্য রকম। নববর্ষের সময় বাড়িতে কলকাতার নাম করা দোকানের মিষ্টি আসত। মা, ঠাকুমারা বাড়িতেও মিষ্টি তৈরি করতেন। পয়লা বৈশাখের দুপুরে সিদ্ধিপাশার অর্ধেক লোকের নিমন্ত্রণ থাকত আমাদের বাড়ি। যাচাই হত, কোন মিষ্টি ভাল— কলকাতার নাকি বাড়ির।”
দেশভাগের অনেক আগেই পরিবারের সকলের সঙ্গে কলকাতায় ছকু খানসামা লেনে চলে আসেন বীণাপাণি। বিয়ের পর থেকে সাকিন নবদ্বীপ। পয়লা বৈশাখ এলেই এখনও তাঁর মনে পড়ে যশোরের মাথা বড় কইমাছের ‘তেল কই’ বা ইলিশের মাথা দিয়ে ‘মুড়িঘণ্টের’ কথা। তিনি বলেন, ‘‘আগের দিন থেকেই বাবার নির্দেশে পুকুরে জাল নিয়ে নেমে পড়তেন জেলেরা। প্রত্যেকের পাতে সমান মাপের কই দিতে হবে। সঙ্গে ইলিশের মাথা আর গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে মুড়িঘণ্ট। ডুমো ডুমো করে কাটা আলু। নামানোর আগে ঘি, গরমমশলা। ওদিকে বড় বড় পাথরের ‘খোড়ায়’ ঘরে পাতা সাদা দই।”
নববর্ষের দুপুরের সেই মাথা বড় যশুরে কইমাছের ‘তেল কই’ বা ইলিশের মাথা দিয়ে ‘মুড়িঘণ্টের’ গন্ধ যেন এখনও নাকে লেগে আছে বীণাপাণির। পড়ন্ত বিকেলে বীণাপাণি বিড়বিড় করেন, ‘‘আমাদের দেশে নববর্ষ যে ভাবে পালন করা হতো, তা এখন কল্পনাই করতে পারবে না। বিজয়া দশমীর থেকেও বড় করে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হতো।”
ব্রিটিশ শাসক মোরেল সাহেব খুলনা জেলায় গড়ে তুলেছিলেন এক জনপদ। তাঁর নাম অনুসারেই মোরেলগঞ্জ। লোকমুখে মোড়লগঞ্জ। বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী, জোতদার, বড় চাষিদের গ্রাম ছিল সেটি। প্রচুর জমির মালিক বিশ্বেশ্বর সাহার একান্নবর্তী সংসারে নববর্ষের দিন মাছের পদ নাকি গুনেই শেষ করা যেত না। বিশ্বেশ্বরের মেয়ে অনুপমা পোদ্দার এখন নব্বই ছুঁইছুঁই। তাঁর চোখে এখনও ভাসে নববর্ষের হেঁশেলের ছবিটা। যৌথ পরিবার। এক এক বেলায় চল্লিশটা করে পাত পড়ত। সকলের জন্য আলাদা আলাদা ‘স্পেশ্যাল ডিশ’। পঁচিশ বছর বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে ছেড়ে নবদ্বীপে এসেছেন অনুপমা। তিনি বলেন, “পয়লা বৈশাখে মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ভেটকি, পারশে, ভুরাল, ইলিশ, চিংড়ি, রুই-কাতলার হাজারও পদ থাকত। তবে মাছে পেঁয়াজ ব্যবহার করা হতো না।’’
পয়লা বৈশাখ দুপুরের মেনুতে এলাকা ভেদে একটা করে বিশেষ পদ থাকত। সেটাই সেই অঞ্চলের নিজস্বতা। মোরেলগঞ্জের লোকজন খেতেন তেতোহীন ভাঙাচোরার শুক্তো। সেই পদে থাকত মাছের মাথা, কাঁটা, ঝিঙে আর বেগুন। নাটোরের রায় আমহাটি গ্রামে সে দিন হতো টকের তরকারি।
তবে সকলের স্মৃতি সুখের নয়। রংপুরের বাসিন্দা ছিলেন যূথিকা সাহা। ১৯৭২ সালে দেশ ছেড়ে চলে আসতে হয় তাঁদের। তখন সবে তিনি কারমেল কলেজে আইএ পড়ছেন। যূথিকা বলছেন, ‘‘দিনটা ছিল ২৫ মার্চ। রাতে গ্রামে সেনা ঢুকল। সে বড় আতঙ্কের সময়। পাড়ার পর পাড়া ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বাবাও সিদ্ধান্ত নিলেন চলে আসার। গ্রাম ছেড়ে চলে আসি ব্রাহ্মণীকুণ্ডা গ্রামে। এর মধ্যেই চলে এল পয়লা বৈশাখ। ব্রাহ্মণীকুণ্ডার লোকজন সে বারেও নববর্ষ পালন করেছিলেন। খাওয়াদাওয়া, নতুন জামাকাপড়, হাসি, গান। সবই ছিল। আমরা কেবল অনাহূতের মতো দূর থেকে শুধু দেখেছিলাম। সে দিন দুপুরে ভাতও জোটেনি। তার ক’দিন পরেই দেশ ছাড়তে হল!”
ছবি: গৌতম প্রামাণিক এবং সুদীপ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy