লিচু বাঁচাতে টাঙানো হয়েছে জাল।— নিজস্ব চিত্র
কোথাও ডাকটা আসছে মিহি স্বরে, কোথাও কানে লেগে থাকছে পরিত্রাণের মরিয়া ছটফটানি— সন্ন্যাসিডাঙার লিচুবাগানে ঝাঁকে ঝাঁকে ‘চোর’ ধরা পড়েছে।
বাগানের মালিরা উদাস। শুকনো পাতা ছেঁটে, গাছতলা ঝেঁটিয়ে ব্যাজার মুখে বিড়িবিড় করছেন, ‘‘এখন ছটফট কর। মরগে যা কে দেখতে যাচ্ছে!’’
ওরা তবু ডানা ঝাপটায়, কেউ সেটুকুও পারে না। চুপ করে প্রহর গোনে — খান দুয়েক ফিঙে, গোটা বারো বুলবুলি, শালিখ, একটা নীল ডানার মাছরাঙা আর অজস্র বাদুড় (ফ্রুট ব্যাট)। লিচু চুরি করতে এসে বমাল ধরা পড়ে গিয়েছে জালে।
ডানা ঝাপটে, মরিয়া চিৎকার করেও সাড়া মিলছে না। দিন কয়েক পরে মরে, শুকিয়ে ঝুলে থাকছে লিচুর জালে।
জৈষ্ঠ্যের ভরা দুপুরে সন্ন্যাসিডাঙা, ইসলামপুর, রঘুনাথগঞ্জের মাঠ বরাবর লিচু বাগান ধরে হেঁটে গেলে জালে পড়া পাখ-পাখালির এমনই আর্তি। মালিরা নির্বিকার গলায় বলছে, ‘‘লিচুর খোঁজে বাগানে ভিড় করছে ফিঙে –বুলবুলি, রাতে বাদুড়ের দল। কত আটকাব বলুন তো, তাই জাল টাঙিয়ে দিয়েছি।’’ আর তাতেই আটকে যাচ্ছে পাখপাখালির দল। দিনভর ঝুলে এক সময়ে নিশ্চুপে মারা যাচ্ছে তারা।
খবরটা বাগানের চৌহদ্দির বাইরে তেমন বেরচ্ছো কই! বন দফতরের কর্তারা জানেন না। বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন বলছেন, ‘‘লিচু বাঁচাতে যাই করুক না কেন, তা বলে পাখি আটকালে তাদের ছাড়িয়ে দেওয়ার দায় তো বাগান মালিকদেরই। স্থানীয় বনকর্তাদের খোঁজ নিতে বলছি।’’ তবে, ওই পর্যন্তই। নদিয়া-মুর্শিদাবাদের বনকর্তাদের কাছে এমন কোনও বার্তা এখনও পৌঁছয়নি। তবে নড়েচড়ে বসেছে এলাকার প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠনগুলি।
তাঁদেরই এক জন অনমিত্র বিশ্বাস বলছেন, ‘‘আমরা বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। আবেদন করেছি যেন জাল টাঙানো হলেও পাখি আটকে গেলে তাদের ছাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।’’
কিন্তু বাগান মালিকেরা সে ডাকে সাড়া দিলে তো!
বছর কয়েক আগেও এ রেওয়াজ ছিল না। তখন পাটা বাঁশ আর খালি টিন পিটিয়েই বাদু-পাখি তাড়ানোর রীতি ছিল।
শিবডাঙ্গার লিচু চাষি স্বপন হাজরা বলছেন, ‘‘আগে বাঁশের ফটফটি (ফাটা বাঁশ) বা খালি টিন লাগানো হত গাছের উপরে। তার সঙ্গে থাকত বড় দড়ি। সেই দড়িতে টান দিয়েই টিন বাজিয়ে পাখি-বাদুড় তাড়ানো হত।’’
কিন্তু তাতে ঢের খরচ। বাগান মালিকেরা বলছেন, এ ভাবেও বাদুড় তাড়ানো লোক রাখতে হত। তাতে তাদের রোজ গুনতে হত দেড়শো থেকে দু’শো টাকা। তাঁদেরই এক জন বলেন, ‘‘টিন-বাঁশের সঙ্গে, আরও একটা পদ্ধতি নেওয়া হত। বাগানে বাদুড় তাড়াতে সাইকেলের টায়ার জ্বালিয়ে রাখা হত। ফাটানো হত বাজি পটকাও।’’ এখন জাল-ই পদ্ধতি।
মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়া অঞ্চলের রামরাজাপুরের লিচু চাষি দীপঙ্কর মন্ডল বলেন, ‘‘এ বার লিচুর ফলন বেশি। কী করব বাদুড় ও শেয়ালের অত্যাচারে জাল টাঙাতে হয়েছে।’’ না হলে বাগান শেষ করে দেবে।
রাতে লিচুর লোভে গাছে হানা দেয় বাদুড়ের দল। সেই দলে প্রায় দু’তিনশো বাদুড় থাকে। আর বৃষ্টি হলে আসে শেয়ালের দল। গাছের নিচুর দিকে লিচু হলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তা খেয়ে যায় তারা। তাদের আটকাতে গেলে এ ছাড়া আর উপায় কী! সমশেরগঞ্জ এলাকায়, মাঠ বরাবর বাগান। দূর থেকে মনে হচ্ছে, গাছগুলো বুঝি নুয়ে পড়েছে। সবুজ পাতাগুলো প্রায় দেখাই যায় না। দিন দুয়েকের বৃষ্টিতে ঝলমলে সবুজের বদলে গাছের পাতাগুলো কেমন পাংশুটে মেরে গিয়েছে। দূরত্বটা মুছে দু-এক পা এগোলে ভুলটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ছে। বয়োঃভারে নূব্জ্য নয়, গাছটা নতমুখ হয়েছে লিচুর ভারে। আর, তার পাংশুটে পাতা আদতে থোকা থোকা সুবাসিত লিচু। সে গাছ আপাদমস্তক ঢাকা মশারির মতো জালে। আর তাতেই আটকে গিয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে ফিঙে-বুলবুলির দল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy