Advertisement
E-Paper

ক্লাসঘরে একাই জন্মদিন কাটালেন রবীন্দ্রনাথ

মফস্সল স্কুলের শিক্ষকদের বসার ঘরের লম্বাটে একঢালা টেবিলে উপরে একটা যেমন-তেমন হারমোনিয়াম, সঙ্গে তথৈবচ তবলা দিয়ে গানের রিহার্সাল। বাংলার  মাস্টারমশাই যত্ন করে শেখাতেন ‘বীরপুরুষ’ কিংবা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। 

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৯ ০১:৩২
 ব্যতিক্রম: নবদ্বীপ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা সমিতির অবৈতনিক পাঠদান কেন্দ্রে কবিস্মরণ। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র

ব্যতিক্রম: নবদ্বীপ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা সমিতির অবৈতনিক পাঠদান কেন্দ্রে কবিস্মরণ। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র

এত দিন পয়লা বৈশাখের পর থেকেই স্কুলের নিজস্ব রুটিনে বেশ খানিক রদবদল ঘটত। টিফিনের ঘণ্টা পড়লেই একটা ফাঁকা ঘর বদলে যেত মহলা কক্ষে। ঘর না মিললে টিচার্স রুমেই শুরু হয়ে যেত পঁচিশের প্রস্তুতি।

মফস্সল স্কুলের শিক্ষকদের বসার ঘরের লম্বাটে একঢালা টেবিলে উপরে একটা যেমন-তেমন হারমোনিয়াম, সঙ্গে তথৈবচ তবলা দিয়ে গানের রিহার্সাল। বাংলার মাস্টারমশাই যত্ন করে শেখাতেন ‘বীরপুরুষ’ কিংবা ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’।

কোনও স্কুলে পঁচিশ বৈশাখ মঞ্চস্থ হতো নাটক। ওই অনুষ্ঠানে যারা যোগ দিত, ওই ক’দিন তাদের টিফিনের পরে ক্লাস করতে হতো না। দিন যত এগিয়ে আসত, ততই জোরদার হতো মহলা। পঁচিশের সকালে স্কুলের ছবিটাই যেত বদলে। স্কুলের মাঠে বাঁধা সাদামাটা মঞ্চে প্রভাতী রবীন্দ্রজয়ন্তী। এলাকার মানুষ ভিড় করে দেখতে আসতেন। নিজের স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তীর এই স্মৃতি রয়েছে অনেকেরই।

ইদানীং অবশ্য স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের সেই ধরন অনেকটাই পাল্টে গিয়েছে। সরকারি তালিকা অনুযায়ী এখন স্কুলে নানা দিবস পালন করতে হয়। তার মধ্যে রবীন্দ্রজয়ন্তী একটু আলাদা গুরুত্ব পায়। কিন্তু এ বার এই অকাল ছুটির চক্করে পঁচিশে বৈশাখ-শূন্য স্কুলে একাই জন্মদিন কাটালেন কবিগুরু। বেশির ভাগ স্কুলে জন্মদিনে মালাও জুটল না রবি ঠাকুরের। এই নিয়ে মনখারাপ পড়ুয়া থেকে মাস্টারমশাই সকলের। এমনিতেই ৩০ জুন পর্যন্ত ম্যারাথন ছুটি নিয়ে ক্ষুব্ধ পড়ুয়া, শিক্ষক, অভিভাবক সকলেই। তার মধ্যে উদ্‌যাপনহীন পঁচিশে বৈশাখ ক্ষোভে আরও ঘি ঢেলেছে।

মনখারাপের সেই রেশ আছড়ে পড়েছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে। কেউ লিখেছে, “এই প্রথম কোনও স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী হচ্ছে না। ধিক্কার।” কারও বিদ্রূপ, “আজ বেশির ভাগ স্কুলে রবীন্দ্রনাথ অন্ধকার স্টাফরুমে বন্দি থাকবেন আর একা একা গাইবেন ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে।”

কৃষ্ণনগর রামবাক্স চেৎলাঙ্গিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক শিবসুন্দর সান্যালের আক্ষেপ, “রবীন্দ্রজয়ন্তী আমাদের স্কুল জীবনে যে ভাবে পালন করা হতো, এখন আর তেমন হয় না। তবে সরকারি তালিকা অনুযায়ী পালনীয় দিন হিসাবে যেটুকু নিয়মরক্ষা করার মতো হতো, এ বার লম্বা ছুটির জন্য সেটাও হল না।”

সাহিত্যিক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “এখনও শহর থেকে দূরে প্রান্তিক বা গ্রামীণ অঞ্চলের অন্যতম বড় বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী। তার জন্য একটা প্রস্তুতিও ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মতো করেই নিত। কিন্তু এ বারে হঠাৎ করে পড়ে যাওয়া লম্বা ছুটির জন্য সেই সুযোগটা তারা পেল না।”

শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত তমাল মনে করেন, এমনিতেই বাংলা সংস্কৃতি আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কী হবে বাংলা সংস্কৃতির চর্চা করে? — এই-জাতীয় মনোভাব যখন ছড়িয়ে পড়ছে, তখন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ঘিরে জাতিধর্ম নিরপেক্ষ যে বিপুল উদ্‌যাপন তা অনেকটাই থমকে গেল এ বার স্কুলগুলো বন্ধ থাকায়।

যদিও নবদ্বীপ আর সি বি সারস্বত মন্দিরে স্কুলে রবীন্দ্রনাথকে দেওয়ালে মালাহীন একা থাকতে হয়নি। স্কুলের প্রধান, জাতীয় শিক্ষকের সম্মানপ্রাপ্ত বিজনকুমার সাহা বলেন, “এ বারেও আমরা রবীন্দ্রনাথকে জন্মদিনে মালা দিয়েছি। ছুটির জন্য ছাত্রেরা আসতে পারেনি, মাস্টারমশাইরা এসেছিলেন, ঘরোয়া ভাবেই স্মরণ করেছি।”

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এবিটিএ-র কৃষ্ণনগর মহকুমা শাখার সম্পাদক সৌমেন অধিকারী বলেন, “ এটা খুবই দুঃখজনক যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্মদিনে এ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপেক্ষিত হলেন। ছাত্রছাত্রী- শিক্ষকেরা তাঁকে স্মরণ করার সুযোগ পেলেন না।”

তবে পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধমিক শিক্ষক সমিতির নদিয়া জেলা সম্পাদকদের অন্যতম কল্লোল কর বলেন, “এমন নয় যে কাউকে অসম্মান করার জন্য এমনটা করা হয়েছে। প্রচণ্ড গরমের জন্যই এই ছুটি। আগে ছাত্রছাত্রীরা প্রাণে বাঁচবে, তবে তো উদ্‌যাপন। প্রতি বছরই তো নজরুল জন্মজয়ন্তী গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যে পড়ে, কই তখন তো এমন গেল-গেল রব দেখি না। তা ছাড়া সমস্ত স্কুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ছুটির পর স্কুল খুললে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী এক সঙ্গে পালন করা হবে।”

পঁচিশে বৈশাখের আগে গ্রীষ্মের ছুটি পড়ে যায় শান্তিনিকেতনেও। সে কারণে আগেই সেরে ফেলা হয় কবির জন্মদিনের উপাসনা। তবে আপাতত সে সব নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না।

মায়াপুরের ঠাকুর ভক্তিবিনোদ ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তথা বিজেপি নেতা গৌতম পাল বলেন, “ অহেতুক ছুটির সরকারি ফতোয়ায় কবিগুরুর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করতে পারল না রাজ্যের কোনও স্কুল। কী আশ্চর্য কাণ্ড! ৩০ জুন স্কুল খোলার পরে ওই দিবস পালন করলেও তা তাৎপর্যহীন। জোর করে করা হবে।”

Rabindranath Thakur Summer Vacation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy