Advertisement
১৭ জুন ২০২৪

ছেলে বাড়ি ফিরল কফিনে 

সোমবার আহমেদাবাদে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান নবদ্বীপের বাসিন্দা বিক্রম বিশ্বাস (১৮)। আহমেদাবাদের ভূপাল গাঁও রোডের একটি বাড়িতে কর্মসূত্রে থাকতেন ওই যুবক।

দেহ এল বাড়িতে। ইনসেটে, বিক্রম বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র

দেহ এল বাড়িতে। ইনসেটে, বিক্রম বিশ্বাস। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৯ ০১:৫৯
Share: Save:

ঠিক ছিল রাসের পর বাড়ি ফিরবেন। শনিবার রাতে মায়ের সঙ্গে এই কথা হওয়ার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরলেন ছেলে। তবে নিথর, কফিনবন্দি হয়ে।

সোমবার আহমেদাবাদে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান নবদ্বীপের বাসিন্দা বিক্রম বিশ্বাস (১৮)। আহমেদাবাদের ভূপাল গাঁও রোডের একটি বাড়িতে কর্মসূত্রে থাকতেন ওই যুবক। সঙ্গে থাকতেন তাঁর আরও কয়েক জন সহকর্মী। সোমবার দুপুরে ওই বাড়ির লাগোয়া একটি পরিত্যক্ত জলের ট্যাঙ্ক আচমকা ভেঙে পড়লে তার নীচে চাপা পড়েন বিক্রম-সহ আরও কয়েক জন। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা বিক্রমকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

দুর্ঘটনার কিছু ক্ষণের মধ্যেই দুঃসংবাদ পৌঁছে যায় নবদ্বীপ রানিরচড়া বটতলা অঞ্চলে বিক্রমের পাড়ায়। এলাকার সকলের প্রিয় তরতাজা যুবকের মৃত্যুতে গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। অভাবের সংসার সবে ছেলের হাত ধরে একটু ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে ছেলের এ ভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না বাবা বিশ্বজিৎ ভৌমিক। হৃদ্‌রোগী মা লক্ষ্মী ভৌমিক এই খবরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, পেশায় হোটেল কর্মী বিশ্বজিতের এক ছেলে বিক্রম। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বিশ্বজিৎ জানান, বছর দেড়েক যাবৎ ছেলে আহমেদাবাদে একটি ক্যাটারিং সংস্থায় কাজ করছিল। মালিক বাপি সরকারও রানির চড়া অঞ্চলেরই মানুষ। এলাকার বেশ কিছু ছেলে আহমেদাবাদে তাঁর ক্যাটারিং সংস্থায় কাজ করে ভালই উপার্জন করছেন। বিক্রম তাঁদেরই এক জন।

মঙ্গলবার দুপুরে বিক্রমের কফিনবন্দি দেহ পৌঁছয় রানির চড়ায়। দেহ নিয়ে আহমেদাবাদ থেকে এসেছেন এলাকার দুই যুবক তথা বিক্রমের সহকর্মী গোপাল দাস এবং জগন্নাথ সরকার। তাঁরা জানান, ভোপাল গাঁও রোডের যে বাড়িতে তাঁরা থাকতেন, সেই বাড়ির পাশেই বহু পুরনো আমলের একটি পরিত্যক্ত ট্যাঙ্ক আছে। জরাজীর্ণ সেই ট্যাঙ্কটি ভেঙে ফেলার জন্য এলাকার মানুষ বহু বার স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছে। কোনও ফল হয়নি। আহমেদাবাদে লাগাতর বর্ষণ চলছে। তারই জেরে সোমবার দুপুরে আচমকা ভেঙে পড়ে ওই ট্যাঙ্ক। প্রথমে সেটি পড়ে একটি গাছের উপরে। সেই গাছের নীচেই ছিল ক্যাটারিং সংস্থার রান্নাঘর। সেখানে জনা চারেক মানুষ কাজ করছিলেন। ঘরের ভিতর এবং বাইরে মিলিয়ে চাপা পড়া আহতের সংখ্যা দশ জন। তার মধ্যে বিক্রম-সহ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।

সোমবার বিকেল থেকেই নবদ্বীপ পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের বিবেকানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা ঘেঁষা টিনের চালে ছোট্ট বাড়িতে জটলা। একচিলতে উঠোনে পা দেওয়ার উপায় নেই। মঙ্গলবার দুপুরে বিক্রমের মরদেহ এসে পৌঁছনোর আগেই প্রাক্তন ছাত্রের মৃত্যুতে শোকসভা করে ছুটি দেওয়া হয় পাড়ার প্রাথমিক স্কুলে।

বিক্রমের বাবা বিশ্বজিৎ ভৌমিকের বাজারে দেড় লক্ষ টাকার উপর ঋণ। তিনি বলেন, “মেয়ের বিয়ে, বাবার মৃত্যু এবং স্ত্রীর অস্ত্রোপচারের ঋণে ডুবে আছি। আমার ওই ছেলে দিনরাত খেটে সে দায় আমার সঙ্গে ভাগ করে সামাল দিচ্ছিল। আমার একমাত্র ভরসা ছিল ও। এখন আমি কী করব?”— এ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

শনিবার রাতে শেষবার বাবাকে বিক্রম বলেছিলেন— “আর ক’টা দিন একটু কষ্ট করো। আমি তো আছি।”

বাবাকে দেওয়া সেই কথা রাখতে পারলেন না বিক্রম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Accident Nabadwip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE