Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

কার অনুমতিতে সম্মেলন কৃষ্ণনগর রবীন্দ্রভবনে, প্রশ্ন

জেলা প্রশাসনের কেউই জানেন না। তাঁরা নাকি অনুমতিও দেননি। অথচ সকলের চোখের সামনে ‘অসম্পুর্ণ’ রবীন্দ্রভবনে রীতিমতো ঢাকঢোল বাজিয়ে সম্মেলন করল তৃণমূলের কর্মচারী সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন’। শুধু তাই নয়, সরকারি সম্পত্তি ব্যবহার করলেও কোনও রকম ভাড়া না দিয়েই ব্যবহার করা হল রবীন্দ্র ভবনের বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধাও। যদিও এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছেন না সম্মেলনের আয়োজকরা।

সুনসান জেলা প্রশাসনের দফতর। বুধবার দুপুর বারোটা নাগাদ ছবিটি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।

সুনসান জেলা প্রশাসনের দফতর। বুধবার দুপুর বারোটা নাগাদ ছবিটি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:২৬
Share: Save:

জেলা প্রশাসনের কেউই জানেন না। তাঁরা নাকি অনুমতিও দেননি। অথচ সকলের চোখের সামনে ‘অসম্পুর্ণ’ রবীন্দ্রভবনে রীতিমতো ঢাকঢোল বাজিয়ে সম্মেলন করল তৃণমূলের কর্মচারী সংগঠন ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশন’। শুধু তাই নয়, সরকারি সম্পত্তি ব্যবহার করলেও কোনও রকম ভাড়া না দিয়েই ব্যবহার করা হল রবীন্দ্র ভবনের বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধাও। যদিও এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছেন না সম্মেলনের আয়োজকরা। তাঁদের পাল্টা দাবি, সংশ্লিষ্ট সমস্ত দফতরের ‘অনুমতি’ নিয়েই তাঁরা রবীন্দ্রভবনে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। আর এই সম্মেলনকে ঘিরে শুরু হয়েছে অন্য বিতর্কও। প্রশ্ন উঠছে শহরের সাংস্কৃতিক কর্মীরা যখন বারবার চেয়েও তাদের অনুষ্ঠান বা উৎসব করার জন্য মঞ্চ পাচ্ছেন না, তখন কীভাবে একটি রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন সেই রবীন্দ্রভবনেই সম্মেলন করার অনুমোদন পেল? যদিও এই বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা।

গত বছর ২৭ জানুয়ারি এই রবীন্দ্রভবনে শেষ বার নাটক করেছিল ‘নাট্যবন্ধু’। তারপর থেকে শুরু হয় রবীন্দ্রভবনের সংস্কারের কাজ। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে প্রায় ৩ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রবীন্দ্রভবন সংস্কারের কাজ চলছে। এরই মধ্যে গত ৮ অগস্ট নবরূপে নির্মিত রবীন্দ্রভবনের উদ্বোধন করে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সংস্কারের বেশ কিছু কাজ এখনও বাকি রয়েছে। ফলে এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রভবন ব্যবহারের অনুমতি পাচ্ছে না শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। রবীন্দ্রভবন না পাওয়ায় অনেকেই তাঁদের বাৎসরিক অনুষ্ঠান বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন কিংবা পিছিয়ে দিয়েছেন। সেই পরিস্থিতিতে তাঁদেরই চোখের সামনে রবীন্দ্রভবনে শাসক দলের সরকারী কর্মীদের সম্মেলন করতে দেখে তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুব্ধ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁদেরই একজন বলছেন, “প্রতি বছর অগস্ট মাসে আমার সংস্থার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাৎসরিক অনুষ্ঠান করি। কিন্তু এ বার রবীন্দ্রভবন না পাওয়ায় অনুষ্ঠানটাই বাতিল করে দিতে হল।” তিনি বলেন, “আমি একাধিকবার গিয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু কাজ অসম্পূর্ণ আছে বলে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ আজ আমারই চোখের সামনে সেই একই মঞ্চে সম্মেলন হল।”

কৃষ্ণনগর সাংস্কৃতিক মঞ্চের সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শহরের সাংস্কৃতিক কর্মী বা প্রতিষ্ঠানগুলি যখন তাদের অনুষ্ঠান করার জন্য রবীন্দ্রভবন চাইতে যাচ্ছে তখন তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে এখনও নাকি নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। তাহলে কীভাবে একটি সংগঠনের সম্মেলন করার জন্য অনুমতি দেওয়া হল? এই অনুমতিই বা কে দিলেন? শহরের সাংস্কৃতিক কর্মীরা কিন্তু সেটা জানতে চাইছেন।” শুধু সাংস্কৃতিক কর্মীরাই নয়, বিষয়টিকে ভাল ভাবে নিচ্ছেন না শহরের সাধারণ মানুষও। তাঁদের অভিযোগ, সামনে শারদোৎসব। অথচ রবীন্দ্রভবন ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে এই শহর সাংস্কৃতিক উৎসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ দিকে সেই রবীন্দ্রভবনেই সম্মেলন হচ্ছে শাসক দলের।

সাধারণ মানুষ কিংবা সাস্কৃতিক সংগঠনগুলো যাই বলুক না কেন তাতে অবশ্য বিশেষ কোনও হেলদোল নেই শাসক দলের। সংগঠনের জেলা স্তরের নেতা ও এই সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক অতনু রায় বলছেন, “এর মধ্যে তো অন্যায় কিছু নেই। কয়েক দিন আগেই তো এখানে সরকারি অনুষ্ঠান হয়েছে। তাছাড়া আমরা তো শুধু মঞ্চটাই ব্যবহার করেছি। বাকি সব কিছু আমরা বাইরে থেকে ভাড়া করে এনেছি।” কিন্তু কার কাছ থেকে তাঁরা রবীন্দ্রভবনে সম্মেলন করার অনুমতি পেলেন? কীভাবেই বা দেওয়া হল এই অনুমতি? বিশেষ করে পূর্ত দফতর যেখানে এখনও পর্যন্ত রবীন্দ্রভবনের সংস্কারের কাজ সম্পুর্ণ করে জেলা প্রশাসনকে হস্তান্তর করেনি। কোনও রকম রাকঢাক না রেখে অতনুবাবু বলেন, “আমরা যে আজ রবীন্দ্রভবনে সম্মেলন করব তা জেলাশাসক জানেন। আমরা তাঁকে জানিয়েছি। পাশাপাশি আমরা পূর্ত দফতরের নদিয়া ডিভিসনের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে অনুরোধ করেছিলাম যাতে আমাদেরকে রবীন্দ্রভবন ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়। ওই দু’জনের কাছ থেকেই আমরা মৌখিক ভাবে অনুমতি নিয়েছি।” তবে জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, “আমার কাছ থেকে কেউ অনুমতি নেয়নি। কীভাবে রবীন্দ্রভবনের ব্যবহারের অনুমতি পেল, কে অনুমতি দিল তা খতিয়ে দেখব।” আবার পূর্ত দফতরের নদিয়া ডিভিসনের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অভিজিৎ চক্রবর্তী বলেন, “শুনেছি রবীন্দ্রভবনে নাকি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিন্তু আমি কাউকে সেখানে কোনও অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিইনি। লিখিত ভাবে আমার কাছে কেউ আবেদনও করেনি।”

সরকারি ওই প্রেক্ষাগৃহ ব্যবহার করার জন্য শাসক দলের ওই সংগঠনের কাছে কি ভাড়া নেওয়া হয়েছে? জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সংস্কারের পর নবরূপে প্রেক্ষাগৃহটি হাতে পাওয়ার পর রবীন্দ্রভবনের পরিচালন সমিতি তার ভাড়া ঠিক করবে। কিন্তু এখনও তো ওই ভবন হস্তান্তরই হয়নি। তাহলে ভাড়াই বা ঠিক হল কী ভাবে? তাহলে কি কোনও ভাড়া না দিয়েই সরকারি এই প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠান করল শাসক দলের শাখা সংগঠন? রবীন্দ্রভবনের পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা নদিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি তৃণমূলের বানীকুমার রায় বলেন, “আমি তো কাউকে কোনও অনুমতি দিইনি। তাছাড়া অনুমতি দিতে পারেন জেলার তথ্য সংস্কৃতি দফতরের আধিকারিক। তবে যাঁরাই রবীন্দ্রভবন ব্যবহার করুক না কেন তাঁদের ভাড়া দিতে হবে। তেমন হলে আমরা পুরনো ভাড়াই নেব।” কিন্তু কী ভাবে? সে প্রশ্নের অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি। জেলার তথ্য সংস্কৃতি দফতরের আধিকারিক পাসাং দর্জি বল বলেন, “রবীন্দ্রভবন ব্যবহারের অনুমতি আমি কাউকে দিইনি। তাই এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।”তবে অতনুবাবুর সহজ স্বীকারোক্তি, ‘‘না, ভাড়া নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও কথা হয়নি।’’

শহরবাসীর প্রশ্ন, “বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও মোটা টাকা দিয়ে রবীন্দ্রভবন ভাড়া নেয়। তাদের ক্ষেত্রে কোনও ছাড় পর্যন্ত দেওয়া হয় না। সেখানে শাসক দলের সরকারি কর্মচারি সংগঠন কীভাবে কোনও ভাড়া না দিয়েই রবীন্দ্রভবন ব্যবহার করল?’’ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্ত। এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “আমি যত দূর জানি, সব রকম আইন-কানুন ও শর্ত মেনেই রবীন্দ্রভবন ব্যবহার করা হয়েছে।” তাহলে কে সঠিক কথা বলছেন, শাসক দলের নেতারা নাকি সরকারি আধিকারিকেরা? প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

এ দিকে এই সম্মেলনের জেরে চরম হয়রান হয়েছেন সাধারণ মানুষ। জেলা প্রশাসনিক ভবনের দোতলায় ভূমি ও রাজস্ব দফতরের দরজার সামনে বেলা ১১টা থেকে দাঁড়িয়েছিলেন দেবগ্রামের রতন মণ্ডল। এসেছিলেন জমি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে। কিন্তু অফিসে চেয়ার-টেবিল থাকলেও কোনও লোকজনের দেখা না পেয়ে দুপুর ২ টো পর্যন্ত অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন তিনি। শুধু ভূমি ও রাজস্ব দফতর নয়, বুধবার জেলা প্রশাসনিক ভবনের প্রতিটি দফতরের সিংহভাগ কর্মীদের চেয়ার-টেবিল ছিল ফাঁকা। ‘গণছুটি’ নিয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনে তৃণমূলের ডাকা ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের’ সম্মেলনে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তের সরকারি দফতরের অবস্থাও ছিল তথৈবচ। ফলে অফিসে এসে দেখা না পেয়ে রতনবাবুর মতো হয়রান হয়েছেন অনেকেই।

এ দিন জেলা প্রশাসনিক ভবনে নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকরা চলে এলেও আসেননি সিংহভাগ কর্মী। ফলে তেমন কোনও প্রশাসনিক কাজকর্মই হয়নি বলে জানিয়েছেন আধিকারিকরা। রাজ্য কোর কমিটির আহ্বায়ক দিব্যেন্দু রায় বলেন, “আমরা কিন্তু সবাইকে আসতে বলিনি। মানুষের যাতে কোনও রকম সমস্যা না হয় তারজন্য প্রতিটি দফতরে কিছু কিছু করে কর্মী রেখে এসেছি।” কাজের দিনে অফিসের এমন চেহারা কেন? জেলাশাসক পিবি সালিমের উত্তর, “ওঁরা ছুটি নিয়েছেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE