অন্নপ্রাশনের পোশাকে। নবদ্বীপে মহাপ্রভু মন্দিরে। —নিজস্ব চিত্র
নবদ্বীপে এক উৎসব শেষের কুঞ্জভঙ্গের বেদনা মিলিয়ে যায় পরের উৎসবের অধিবাসে। দোল শেষ হওয়ার পরও এ শহর থাকে দোলের রঙে রঙিন।
সকাল সন্ধ্যার বাতাসে ভাসছে গুঁড়ো গুঁড়ো আবির। ভরসন্ধ্যায় যানজমাট পথে সব কিছু থামিয়ে দিয়ে হঠাৎ ঢুকে পড়ছে নগর সংকীর্তনের দল। সমবেত কন্ঠে শোনা যায়, “তোঁহার চরণে মন লাগু রে।” তাদের খালি পা। কপালে চন্দনের তিলক। মুহূর্তের মধ্যে শহরের পিচঢালা পথ যেন বৈষ্ণব ভজনকুঠির নাট মন্দির। ব্যস্ত পথচারী হাতের কাজ ফেলে দু’পা হেঁটে নেন পরিক্রমার সঙ্গে। চলন্ত রিকশার হ্যান্ডেল ছেড়ে চালক দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে ওঠেন জয়গৌর। বিড়বিড় করে গলা মেলান আরোহী। ব্যস্ত শহুরে মানুষ মুহূর্তের জন্য একাকার হয়ে যান সুর আর সুগন্ধে।
দোল শেষ হওয়ার পরেও চৈতন্যধাম নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠে উৎসব অব্যহত থাকে। নবদ্বীপের একান্ত নিজস্ব সেই সব দোল উৎসবের নাম—তৃতীয় দোল, চতুর্থ দোল, পঞ্চম দোল, সপ্তম দোল কিংবা দশম দোল। বৃন্দাবনের বর্ষাণা হোলি, জাওয়াট হোলি বা নন্দগ্রাম হোলির মতো, এ সব দোলের প্রতিটি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। দোলের পরেও এতদিন ধরে দোল ভূ-ভারতে আর কোথাও হয় না। এখানে হয় কেন ? উত্তরে নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “সারা দেশ জুড়ে ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিনে রাধাকৃষ্ণের দোল পালন করা হলেও নবদ্বীপে সেদিন কেবল গৌর পূর্ণিমা, চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি। পরদিন থেকে বিভিন্ন মন্দির বিভিন্ন দিনে পালন করে থাকে মহাপ্রভুর দোল। ”
যদিও ঠিক কবে থেকে এই ধারাবাহিক দোলের সূচনা, তার কোনও পাথুরে প্রমাণ নেই। তবে বিভিন্ন মন্দিরের প্রধানের জানিয়েছেন, আড়াইশো থেকে তিনশো বছর ধরে এই ভাবে দোল উদযাপিত হয়ে আসছে নবদ্বীপের বৈষ্ণবমঠগুলিতে। এখানেই আর পাঁচ জায়গার সঙ্গে নবদ্বীপের দোল উৎসবের পার্থক্য। ধারাবাহিক এই দোল উৎসবের কারনে মরসুমি বাণিজ্যেও হয় দীর্ঘদিন ধরে। কেননা বিভিন্ন মঠ মন্দিরের নিজস্ব দোল উপলক্ষে বিপুল শিষ্য সমাগম হয়। আবার যারা দোলের ভিড়ে শহরে আসতে পারেন না, তাঁরাও অনেকে এই সময়ে শহরে আসেন।
ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্ব যে বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতির উপর, সেই সমিতির সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী বলেন, “মহাপ্রভু মন্দিরে পালিত হয় দশম দোল। পূর্ণিমার দশ দিনের মাথায় এই দোল, তাই দশম দোল। দোলের দিন আমাদের গোস্বামী পরিবারের কেউ আবির রঙ স্পর্শ করেন না, দোল খেলেন না। ওই দিন মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি, সুতরাং রঙ আবিরের প্রশ্নই নেই। পূর্ণিমার ন’দিনের মাথায় হয় মহাপ্রভু মন্দিরের নিজস্ব দশম দোল।”
একই ভাবে গোরাচাঁদের আখড়ায় পালিত হয় দশম দোল। সোনার গৌরাঙ্গ বাড়ি বা শ্রীবাসঅঙ্গনে হয় পঞ্চম দোল। বড় আখড়ার শ্যামসুন্দর মন্দিরে হয় তৃতীয় দোল। সোনার গৌরাঙ্গ মন্দিরের প্রধান স্বরূপ দামোদর গোস্বামী বলেন, “নবদ্বীপের অপর নাম গুপ্ত বৃন্দাবন। রাধাকৃষ্ণের দোল শেষ না হওয়া পর্যন্ত মহাপ্রভুর দোল বিধেয় নয়। সেই জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষেরা মূল দোলের পাঁচ দিন পরে পঞ্চম দোলের প্রথা চালু করেছিলেন অন্তত আড়াই’শো বছর আগে। পঞ্চম দোলের আগের দিন হয় চাঁচর বা নেড়াপোড়া। ‘চোদ্দমাদল’ বা মৃদঙ্গ নিয়ে নগরকীর্তনে বেড়িয়ে নিত্যানন্দ বংশধরেরা গাইতে থাকেন হরিদাস ঠাকুর রচিত ওই পদ—তোঁহার চরণে মন লাগু রে।
মহাপ্রভু মন্দিরে এই ধারাবাহিক দোল উৎসব শেষ হয় দোলের দশম দিনে। নাম দশম দোল। মহাপ্রভুর সেবাপুজোর যাবতীয় দায়িত্ব সামলান শ্রীশ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতি। দশম দোল প্রসঙ্গে তাঁদের ব্যাখ্যা একটু অন্যরকম। তাদের তরফে সুদিন গোস্বামী বলেন, “ বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর দুই প্রিয় সখি কাঞ্চনা এবং অনিতা মহাপ্রভু এবং বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে এই দশমী তিথিতে রং খেলেছিলেন। সেই বিশেষ তিথিকে স্মরণে রেখে আমাদের পূর্বসুরি রামকন্ঠ গোস্বামী, পাঁচুগোপাল গোস্বামী বা ফণিভূষণ গোস্বামীরা দশম দোলের প্রচলন করেন।”
তিনশো বছর ছুঁই ছুঁই দশম দোলের দিন মহাপ্রভুকে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী সহ দোলনায় দোলানো হয়। গোস্বামী পরিবারের মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে নগর পরিক্রমায় অংশগ্রহণ করেন। সারা শহর ঘুরে মন্দিরে পৌঁছনোর পরে শুরু হয় হোলি কীর্তন, ফাগু খেলত গোরা বিষ্ণুপ্রিয়া সঙ্গে, মারে পিচকারি দুঁহুঁ দোঁহা অঙ্গে। শুরু হয় মহাপ্রভুর পায়ে আবির দিয়ে রং খেলা। এদিন দোলের পরিক্রমায় শোনা যায় কিছু দুর্লভ অপ্রচলিত কীর্তনের পদ। সুদিনবাবু বলেন “দশম দোলের যাবতীয় গান মহাপ্রভু বাড়ির নিজস্ব সম্পদ। এর কথা সুর সবই গোস্বামীদের রচনা।” এ দিন মহাপ্রভুকে নানা রকমের সরবত দেওয়া হয়, সঙ্গে ফল। আর রাতে হয় খিচুড়ি। বছরে এই একটি দিনেই মহাপ্রভু মন্দিরে রাতে অন্ন ভোগ দেওয়ায় হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy