শামিম মণ্ডল
দু’দিন আগে মাধ্যমিকের ফল বেরোলে ঝলমল করে উঠেছিল নদিয়া। পড়শি, মুর্শিদাবাদও তালিকার উপরের দিকেই ছিল। শুক্রবার, রাজ্যের হাইমাদ্রাসা ফল বেরতে দেখা গেল, ফের সামনেই সারিতেই রয়েছে দক্ষিণবঙ্গের এই দুই জেলা।
এমনকী ফাজিল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে নদিয়ারই হাঁসখালির শামিম মণ্ডল, আর আলিম পরীক্ষায় রাজ্যে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে মুর্শিদাবাদের আব্দুল জব্বর।
হাইমাদ্রাসা বোর্ড সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বছর নদিয়ার পড়ুয়াদের ফল ভাল হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের সচিব সৈয়দ নুরুস সালাম জানান, এ বছর প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, নদিয়া-মুর্শিদাবাদের পড়ুয়াদের ফল ভাল হয়েছে। পর্ষদ প্রকাশিত মেধা তালিকায় প্রথম দশের মধ্যে মুর্শিদাবাদের পাঁচ পড়ুয়ার নাম রয়েছে। মাদ্রাসা বোর্ডের সভাপতি ফজলে রাব্বি জানান, মুর্শিদাবাদের ১০,৫১৪ জন ছাত্রছাত্রী এ বছর হাই মাদ্রাসার পরীক্ষায় বসেছিল। উত্তীর্ণ হয়েছে ৭,৮০৫ জন। এ বছর মুর্শিদাবাদের পড়ুাদের সাফল্যের হার বেশ ভাল। মেধা তালিকার উপরের দিকে জেলার বেশ কয়েকজন পড়ুয়া রয়েছে। নিতান্তই দারিদ্র সীমার নীচের পরিবার থেকে উঠে এসে ওই পড়ুয়ারা সফল হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামের এই পড়ুয়ারা কার্যত নিজেদের চেষ্টায় ও শিক্ষকদের সাহায্যে এই সাফল্য অর্জন করেছে।
নদিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকার থানারপাড়া এইচএম হাই মাদ্রাসার পড়ুয়া মুবিন গেফারি ৭১০ পেয়েছে। বাবা মুস্তাক হোসেন পেশায় মুদির দোকানদার। বকুলতলা গ্রামেই ছোট মুদির দোকান চালিয়ে কোনওরকমে চার জনের সংসার চালাতে হয় মুস্তাককে। এরই মধ্যে ছেলের সাফল্যে উদ্বেলিত মুস্তাক। তবে চিন্তাও যেন কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁকে। আর মুবিনের কথায়, সে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। চাপড়ার বেলতলা হাই মাদ্রাসার ছাত্রী আরাধনা খাতুন ৬৬৬ পেয়েছে। সে তার স্কুলের সেরা হয়েছে। ওই মাদ্রাসার সহ শিক্ষক আব্দুল রহিম জানান, আরাধনা নিয়মিত ক্লাস করত। পরিশ্রমের ফল পেয়েছে সে।
এ বছর ফাজিল (উচ্চমাধ্যমিক) পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথম হয়েছে শামিম মণ্ডল। হাঁসখালির শ্যামনগরের মাঠপাড়ার শামিম বনগাঁর বনগাঁর বনগ্রাম আবু বকর হজরত পীর দারুল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসার ছাত্র। শামিম বছর দুয়েক আগে আলিম (মাধ্যমিক সমতুল) পরীক্ষায় রাজ্যে যুগ্ম ভাবে প্রথম হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘‘পরীক্ষা ভালো হয়েছিল। কিন্তু হব বলে ভাবিনি। প্রথম হওয়ার অনুভূতিটাই আলাদা।’’ শামিম আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি নিয়ে পড়াশুনা করতে চান। শামিমের বাবা শওকত আলি মণ্ডল পেশায় ক্ষুদ্র চাষি। বিঘা চারেক জমিতে আবাদ করে কোনওরকমে সংসার চালান। তিনি জানান, কষ্টেসৃষ্টে হলেও শামিমকে পড়াবেন। ছেলে গোটা এলাকার মুখ উজ্জ্বল করল। ওই মাদ্রাসার মাদ্রাসার শিক্ষক মহম্মদ ইব্রাহিম গায়েন বলেন, “শামিমের সাফল্য আমাদের প্রতিষ্ঠানের মুখ উজ্জ্বল করেছে। এটা তার মেধা ও শ্রমের ফল।’’
৭৪৭ পেয়ে হাই মাদ্রাসার পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছে দৌলতবাদের গঙ্গাপ্রসাদ হাই মাদ্রাসার সাবির আহমেদ। চতুর্থ হয়েছে রানিনগরের আমিরাবাদ হাই মাদ্রাসার ছাত্রী মুস্তিকা খাতুন। তার প্রাপ্ত
নম্বর ৭৪৩। ৭৪১ নম্বর পেয়ে রাজ্যের মধ্যে পঞ্চম হয়েছে রামনগর হাই মাদ্রাসার গোলাম সারওয়ার সরকার। রাজ্যের মধ্যে যুগ্ম ভাবে দশম হয়েছে জেলার দুই ছাত্র। ভাবতা আজিজিয়া হাই মাদ্রাসার মহম্মদ ইউসুফ জামান এবং লালগোলা আইসিআর হাই মাদ্রাসার মহম্মদ হাবিবুল্লা—যুগ্ম ভাবে দশম হয়েছে। দু’জনেরই প্রাপ্ত নম্বর ৭২৬।
সাবির তার সাফল্যের পুরো কৃতিত্বই দিচ্ছে মাদ্রাসার শিক্ষকদের। সে জানায়, পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকেই শিক্ষকরা কয়েকজন উৎসাহী পড়ুয়াকে নিয়ে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। সে নিয়মিত ওই ক্লাসগুলি করত। শিক্ষকদের সহায়তায় এই সাফল্য এসেছে। ছেলের সাফল্যের মধ্যেও বাবা
আব্দুল হান্নানের কপালে অবশ্য চিন্তার ভাঁজ। হান্নানের সম্পত্তি বলতে মেরেকেটে বিঘে খানেক জমি। তা থেকে যা আয় তাতে সংসার চলে না। ফলে দিন গুজরান করতে অন্যের জমিতে দিনমজুরি করতে হয়।
সাবিরের স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়া। জেলার আর এক কৃতী গোলাম সারওয়ার সরকারের রানিনগরের বাবলাবোনা গ্রামের বাসিন্দা। সারওয়ারও ছোট থেকেই টানাটানির সংসারে বড় হয়েছে। বাবা গোলাম হোসেন পেশায় প্রান্তিক চাষি। সারওয়ার ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চায়। তাঁর কথায়, ‘‘স্রেফ অভাবের কারণে গ্রামের অনেকেই মাঝপথে স্কুল-ছুট হয়ে যায়। শিক্ষক হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।’’
চাষির ছেলে হাবিবুল্লা সকালে বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ সেরে স্কুলে যেত। তারপর আবার রাত জেগে পড়াশোনা। জেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম মুস্তিকার বাবা রবিউল হাসান পেশায় রেশন ডিলার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy