Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আমরা কখন আসি, কখন যাই, উনি দেখতে এসেছেন!

হাসপাতালের সাধারণ বিভাগের আউটডোরে ডাক্তারদের জন্য রাখা চারটে চেয়ার-টেবিলই ফাঁকা। দু’দিকে রোগীদের বসার জায়গায় কম করেও জনা পঁচিশ রোগী অপেক্ষায়। 

সোমবার বেলা পৌনে ১০টা। চাকদহ হাসপাতালের আউটডোরে ডাক্তারদের চেয়ার ফাঁকা। নিজস্ব চিত্র

সোমবার বেলা পৌনে ১০টা। চাকদহ হাসপাতালের আউটডোরে ডাক্তারদের চেয়ার ফাঁকা। নিজস্ব চিত্র

সৌমিত্র সিকদার
চাকদহ শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৮ ০২:২৭
Share: Save:

দুর্ভোগের খবরটা আসছিল অনেক দিন ধরেই। নিজে চোখে যাচাই করতে পৌঁছনো গেল চাকদহ স্টেট জেনারেল হাসপাতালের আউটডোরে।

সপ্তাহের প্রথম দিন। সোমবার, সকাল ৯টা।

হাসপাতালের সাধারণ বিভাগের আউটডোরে ডাক্তারদের জন্য রাখা চারটে চেয়ার-টেবিলই ফাঁকা। দু’দিকে রোগীদের বসার জায়গায় কম করেও জনা পঁচিশ রোগী অপেক্ষায়।

আউটডোর খোলার কথা সকাল ৯টায়। ডাক্তারদের চেয়ারের পিছনে দেওয়াল ঘড়ির বলছে সওয়া ৯টা বেজে গিয়েছে। কাঁটা ঘুরছে, রোগীর ভিড়ও বাড়ছে।

ডান দিকের বেঞ্চে বসে লাগাতার কেশে যাচ্ছিলেন চাকদহ শহরের পালপাড়া থেকে আসা ৭৩ বছরের ছায়া পাল। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কোনও রকমে বললেন, ‘‘ভিড় এড়াতে পৌনে ৯টার আগেই চলে এসেছি। এসে শুনছি, ১০টার আগে ডাক্তার আসেন না।’’

পাশেই বসেছিলেন রানাঘাটের পায়রাডাঙা থেকে আসা আশি পেরনো তারা বিশ্বাস। পায়ের ব্যথা বেড়েছে। কাতর গলায় বললেন, ‘‘কী দুর্ভোগ বলুন তো! সেই কখন থেকে এতগুলো লোক এসে বসে রয়েছে, ডাক্তারবাবুদের দেখা নেই।’’

৯টা ৫০। সাধারণ বিভাগের প্রথম ডাক্তারবাবু এসে ঢুকলেন। বাঁ দিকে প্রসূতি বিভাগে তখনও আসেননি কেউ। মহিলাদের বসার জায়গায় ঠাসা ভি়ড়। হঠাৎই কে যেন বলল, ‘ডাক্তারবাবু আসছেন।’ হুড়মুড় করে আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে প়ড়লেন সকলে। ভিড় আর ঠেলাঠেলির মধ্যে অসুস্থই হয়ে পড়লেন এক জন। তাঁকে বেঞ্চে বসিয়ে চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে ধাতস্থ করা হল।

একটু এগিয়েই চক্ষু বিভাগ। দরজা তখনও বন্ধ। সামনে দাঁড়িয়ে-বসে রয়েছেন কয়েক জন রোগী। চাকদহের ছাত্র মিলনী মাঠের পাশ থেকে এসেছিলেন মালতি বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘টোটো ভাড়া নেয় ১০ টাকা। সামর্থ্য নেই। হেঁটেই এসেছি। সেই ৯টা থেকে বসে আছি।’’

পাশে নাক-কান-গলা বিভাগেও একই অবস্থা। কানে ব্যথা নিয়ে চাকদহেরই তাতলা থেকে এসেছিলেন সুরঞ্জন দাস। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে গেল, এসে বসে আছি। কারও দেখা নেই।’’ শেষমেশ বেলা ১০টা নাগাদ সেখানে এসে হাজির হলেন এক চিকিৎসক, নাম শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। রোগী দেখার ফাঁকেই তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘‘এত দেরি করে এলেন কেন? কখন থেকে রোগীরা অপেক্ষা করছেন!’’

শুনেই চটে উঠে তিনি বলতে লাগলেন— ‘‘আমি কখন এসেছি, আপনি জানেন? আমি ৯টার আগে হাসপাতালে ঢুকে গিয়েছি। সুপার ছুটিতে থাকায় আমিই এখন এই হাসপাতালের দায়িত্বে।’’

আনন্দবাজার: তা হলে তো ভালই হল। আপনার থেকেই সামগ্রিক বিষয়টা জেনে নেওয়া যাবে।

চিকিৎসক: কী সামগ্রিক বিষয়?

আনন্দবাজার: দীর্ঘদিন ধরেই এই হাসপাতাল নিয়ে অভিযোগ যে, চিকিৎসকেরা ঠিক সময়ে আউটডোরে বসেন না। সকলে সব দিন আসেনও না। আপনার কী বক্তব্য?

গলা এক পর্দা চড়িয়ে চিকিৎসক বলেন, ‘‘এ নিয়ে আমি কিছুই বলতে পারি না। তবু বলছি, ডাক্তারেরা সময় মতোই হাসপাতালে আসেন এবং দায়িত্ব পালন করেন!’’

আর কিছু জিজ্ঞাসা করার ছিল না। তাই ওই চিকিৎসকের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে অন্য ডাক্তারবাবুদের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করা হয়। চিকিৎসক যে প্রতিবেদককে দূর থেকে লক্ষ রাখছিলেন, তা প্রথমে বোঝা যায়নি।

সামান্য ক্ষণের মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি চিৎকার করতে থাকেন— ‘‘এ দিকে আসুন! আপনি ভুয়ো সাংবাদিক কি না, সেটা আগে দেখা দরকার।’’ নিরাপত্তারক্ষীদের ডেকে বলতে থাকেন, ‘‘একে আটকে রাখো। পুলিশকে খবর দাও।’’

দু’জন রক্ষী এই প্রতিবেদককে বারান্দার এক পাশে নিয়ে গিয়ে বসায়। চিকিৎসক তখন চিৎকার করে চলেছেন, ‘‘আমরা কখন আসি, কখন যাই, তা উনি দেখতে এসেছেন! উনি এ সব দেখার কে? আমাদের দেখার লোক আছে! ’’

ইতিমধ্যে খবর পেয়ে এই পত্রিকার দফতর থেকে ফোন করে ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল, প্রতিবেদক যে ভুয়ো সাংবাদিক নন, তা তাঁকে জানানো। কিন্তু চিকিৎসক ফোন ধরার প্রয়োজন বোধ করেননি।

কিছু ক্ষণ বাদে চাকদহ থানা থেকে পুলিশ এসে দু’পক্ষের সঙ্গেই কথা বলে। সব শুনে এক সাব-ইন্সপেক্টর চিকিৎসককে বলেন, লিখিত ভাবে অভিযোগ জানাতে। কিন্তু চিকিৎসক লিখিত ভাবে কিছু জানাতে নারাজ।

ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে। নদিয়া জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দফতর থেকে হাসপাতালে ফোন আসে। খবর পেয়ে ফোন করেন ছুটিতে থাকা হাসপাতাল সুপার সর্বানন্দ মধু। চাকদহ ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক তন্ময় হালদারও আউটডোরে চলে আসেন।

তার পরেই সুর পাল্টে যায় ওই চিকিৎসকের। তিনি বরং বোঝাতে থাকেন, সাংবাদিকের কী কর্তব্য, কার কাছ থেকে আগাম অনুমতি নিয়ে তবে রোগীদের দুর্ভোগের দৃশ্য দেখতে আসা উচিত।

কাজ শেষ।

সাড়ে ১১টা বেজে গিয়েছে। সব ডাক্তারবাবুই প্রায় এসে গিয়েছেন। আউটডোরে সব টেবিলের সামনেই তখন রোগীদের উপচে পড়া ভিড়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Time Doctor Hospital Schedule
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE