Advertisement
E-Paper

কাফনডা ঢাই হাতের কিনিস বাপ

কুলুঙ্গিতে রাখা পানের ডিব্বা, দোক্তার রংচটা কৌটো আর ছেঁড়া তোশকের নিচে ন্যাতানো গামছার মতো খান কয়েক পাঁচশো টাকার নোট, ব্যাস।

কল্লোল প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:০৪
যাত্রাপুরে দাওয়ায় আছিয়া বেওয়া। —নিজস্ব চিত্র

যাত্রাপুরে দাওয়ায় আছিয়া বেওয়া। —নিজস্ব চিত্র

কুলুঙ্গিতে রাখা পানের ডিব্বা, দোক্তার রংচটা কৌটো আর ছেঁড়া তোশকের নিচে ন্যাতানো গামছার মতো খান কয়েক পাঁচশো টাকার নোট, ব্যাস।

তাঁর উনিশটা বছরের সঞ্চয়।

একটা কাফনের হা পিত্যেশ তাঁকে নিঃশব্দে শিখিয়ে দিয়েছিল সঞ্চয়ের আদি পাঠ।

খান কয়েক ছাগল আর গুটি কয়েক হাঁস-মুরগি— উনিশ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পরে, কখনও ডিম কখনও বা ছাগলের দুধ বেচে ভাত-কচুর দিনযাপনের পরে তাঁর যৎসামান্য সঞ্চয়টুকু এ ভাবেই ঘরের আনাচকানাচে লুকিয়ে রেখেছিলেন আছিয়া বেওয়া।

নব্বই পার করে, প্রথম বার অসুস্থ হয়ে নাতি-নাতনির কাছে সে কথাই ফিসফিস করে কবুল করেছিলেন আছিয়া। কিন্তু তত দিনে বছর যে ঘুরে গিয়েছে! হোগলবেড়িয়ার গ্রামে তাঁর খড়ের চাল গড়িয়ে সে খবর উঠোনেই পা রাখেনি। ‘‘ও নোট তো তামাদি হয়ে গিয়েছে দাদি’’, নাতনির কথা শুনে আছিয়া তাই মিটিমিটি হাসেন, ‘‘নাতিগুলানের রসিকতার শ্যাষ নাই দ্যাখত্যাসি!’’ হোগলবেড়িয়ার প্রান্তিক গ্রামে নোটের কোপ তাঁর দাওয়ায় পড়তেই পারেনি! তাঁর এক টুকরো গ্রামীণ চোহদ্দিতে ছায়া-রোদ্দুর আর হাঁস-মুগির সংসারে টাকার প্রয়োজনই বা পড়ল কোথায়!

আছিয়া বিড় বিড় করেন, ‘‘মইরা গ্যালে ওই নোটটুকুন দিয়াই দাফন করিস রে আমার।’’ বাড়ির দাওয়ায় শুয়ে ক্ষীণ গলায় সে কথাই নাগাড়ে বলে চলেন তিনি।

দাদি অসুস্থ শুনে পড়শি গ্রাম থেকে ছেলে আর নাতনিরা ভিড় করেছিল আছিয়ার যাত্রাপুরের দাওয়ায়। আর, তখনই, বয়সের ভারে ছোট্ট হয়ে আসা বৃদ্ধা নাতনিদের হদিস দেন তাঁর গোপন সঞ্চয়ের।

ঘরের ভাঙা বাক্সে, কাপড়ের ভাঁজে, তোশকের নিচে কিংবা কুলুঙ্গির ডিব্বায় পাঁচশো, একশো, পঞ্চাশ, দশের কুঁচকে যাওয়া অজস্র নোট এক জায়গায় জড়ো করে তাঁর নাতি নাতনিরা অবাক— টাকার অঙ্কটা প্রায় সাড়ে আঠারো হাজার।

টাকার অঙ্ক দেখে কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতেই পড়ে গিয়েছেন আছিয়ার জ্ঞাতিগুষ্টি। উনিশ বছর ধরে একাই থাকেন মহিলা। ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিরা থাকেন দূরে, কেউ পাশের গ্রামগঞ্জে। তা বলে তাঁদেরও নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা।

স্বামী মারা যাওয়ার সময়েই আছিয়া দেখেছেন, অভাবের এই সংসারে একটা কাফনের জন্য কেমন এর-তার কাছে হাত পাততে হয়। সে কথা কি ভুলতে পেরেছেন আছিয়া? সে জন্য এই দু’দশক ধরে কুড়িয়া বাড়িয়ে টাকা জমিয়ে ছিলেন তিনি।

নাতি নাসির শেখ বলছেন, ‘‘দাদি যে অমন টাকা জমাইছ্যান, জানব কেমনে! গুনি দেহি তেরোটা পাঁচশো টাকার নোট। সব মিলিয়ে আঠারো হাজারেরও বেশি টাকা।’’ কিন্তু সে সঞ্চয় ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তাঁরা। গ্রামবাসীরা গজগজ করছেন, ‘‘পাবেই বা কী করে বুড়ির খোঁজ কেউ রাখে?’’ তাঁর অভাব, অসুস্থতা, সুবিধা-অসুবিধার কেই বা ধার ধারে?

আছিয়া তাই কারও ভরসা না করে, সঞ্চয় করে গিয়েছেন। কিন্তু নভেম্বর-রাতে নোট বাতিলের খবর, তার পর দফায় দফায় বিবিধ নিষেধাজ্ঞা— সে খোঁজ আছিয়া রাখলে তো!

মাটির দাওয়ায় শুয়ে রোগ-দীর্ণ আছিয়া শুধুই বিড় বিড় করে চলেন, ‘‘কাফনডা ঢাই হাতের কিনিস বাপ!’’

Elderly woman Old Notes
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy