Advertisement
E-Paper

‘গড়তে দেশ রুখতে চিন’ বনাম ‘দেশ গড়েছিস এ বার হবি শেষ’

হাতুড়ির ‘ড়’টা নিয়ে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তি ছিল। হাতে রং ভেজা তুলি নিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়েই ভাবছিলেন, ‘মেরে দেব নাকি ‘র’!’ যুবকের সংশয় দীর্ণ মুখ দেখে ঘ্যাঁস করে সাইকেল থামিয়ে যিনি বাতলে দিয়ে গিয়েছিলেন সঠিক বানানটা, তিনি কংগ্রেস প্রার্থী।

শুভাশিস সৈয়দ

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪০
ছড়ার লড়াই দেওয়াল জুড়ে। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

ছড়ার লড়াই দেওয়াল জুড়ে। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

হাতুড়ির ‘ড়’টা নিয়ে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তি ছিল। হাতে রং ভেজা তুলি নিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়েই ভাবছিলেন, ‘মেরে দেব নাকি ‘র’!’ যুবকের সংশয় দীর্ণ মুখ দেখে ঘ্যাঁস করে সাইকেল থামিয়ে যিনি বাতলে দিয়ে গিয়েছিলেন সঠিক বানানটা, তিনি কংগ্রেস প্রার্থী।

সেই ঘোর দুপুরটা এখনও বেশ মনে আছে, বাম কর্মীর। বহরমপুরের উপান্তে সেই দুপুরবেলাটার কথা বলার পাঁকে এখনও গড়গড় করে বলে যেতে পারেন একের পর এক ভোট-ছড়া। আর সেই সব স্বনামধন্য কংগ্রেস নেতাদের নাম। বলছেন, ‘‘হ্যাঁ ওঁদের সব্বার নাম মনে আছে, দলের সিনিয়র কমরেডদের মতোই ওঁদের সম্মান করতাম। আসলে কী জানেন, সময়টা ছিল একেবারে অন্যরকম।’’

হারানো ছড়া, ফ্যালফ্যালে দেওয়াল লিখনের মাঝে সেই সব তীক্ষ্ণ শ্লেষ, চিমটি এখনও যেন হামাগুড়ি দিয়ে নেমে আসে স্মৃতিতে। যেখানে এখনও ঝলসে ওঠে— শোনো হে শ্রমিক, শোনো হে কৃষক যারা/ তোমাদের মুক্তি দেবে কাস্তে হাতুড়ি তারা। ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজনের পরে সিপিএম এমনই দেওয়াল লিখে চমকে দিয়েছিল কংগ্রেস আর তাদের সদ্য হাত-ছেড়ে যাওয়া সিপিআই’কে। তবে সেই তীক্ষ্ণতার জবাব এসেছিল দিন দুয়েকের মধ্যেই। কংগ্রেস দেওয়াল লিখেছিল —শোনো হে শ্রমিক, শোনো হে কৃষক যারা/ শ্মশান ঘাটে মুক্তি দেবে কাস্তে হাতুড়ি তারা। পুরনো কংগ্রেস নেতা প্রদীপ মজুমদার ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘মনে আছে,—গড়তে দেশ রুখতে চিন/ কংগ্রেসকে ভোট দিন, কী সব ছড়া লেখা হয়েছে।, ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়!’’ তাঁর মনে হচ্ছে, ‘‘ আরে ভাই, এর চেয়ে তো অনেক ধারালো ছিল আসির দশকও। খাগড়াঘাট স্টেশনে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সে সময়ে লেখা হয়েছিল—চাঁদ ফুটেছে ফুল ফুটেছে/ কদম তলায় কে?/ হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে/ জ্যোতি-প্রমোদের বিয়ে।’’ দিন কয়েকের মধ্যেই পাল্টা দেওয়াল ভরিয়ে দিয়েছিল বামেরা —ঠিক বলেছিস, ঠিক বলেছিস, ঠিক বলেছিস ভাই/ সেই সময়ে ইন্দিরাকে সাজিয়ে আনা চাই।

বহরমপুর শহর কংগ্রেস সভাপতি অতীশ সিংহও মনে করতে পারছেন, —বাবুরাম সাপুড়ে/ কোথা যাস বাপুরে/ আয় বাবা দেখে যা/ দুটো সাপ রেখে যা/ যে সাপের নাক নেই/ চোখ নেই/ বামফ্রন্ট বাবা রে! বলছেন, ‘‘এটা হয়তো তেমন জমকালো নয়, কিন্তু হালের কুরুচিকর দেওয়াল লিখনের চেয়ে ঢের ভালো।’’ তিনি মনে করছেন, ‘‘তখন ছড়ায় সামাজিক প্রেক্ষাপট থাকত। অর্থনৈতিক দিকটিও উপেক্ষিত হত না। ছড়ার মধ্যে ছিল ব্যাঙ্গ, শ্লেষ। কোথায় হারিয়ে গেল।’’

আরএসপি-র প্রাক্তন সাংসদ প্রমথেশ মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘মনে পড়ছে, ৬০’র দশকের কথা। তখন ছাত্র রাজনীতি করি। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে দেওয়ালে ছড়া দেওয়া হল—চিনের কাস্তে-হাতুড়ি/ পাকিস্তানের তারা/ ভেব দেখো এ বার কারা?, আমরা পার্টি অফিসে বসে ঠিক করলাম ছড়া। পাল্টা লেখা হল, খুব রুখেছিস/ দেশ গড়েছিস/ এ বার হবি শেষ।’’ম্লান গলায় তিনি ধরিয়ে দিচ্ছেন,‘‘সেই সব হারানো দিনের জায়গা নিয়েছে কারা—‘ঝান্ডার ডান্ডা/এই দিয়ে করবো তোদের ঠান্ডা’, ভাবলেই মন খারাপ হয়ে য়ায়।’’

মন খারাপ হয়ে যায় তাঁরও, মান্নান হোসেন। শাসক দলের জেলা সভাপতি, একদা কংগ্রেস সাংসদ বলছেন, ‘‘সত্তরের দশকটা মনে আছে? লেখা হতো—দুই বাংলার দুই পশু/ ইয়াহিয়া আর জ্যোতি বসু।’ আবার তাঁদের সম্মানও করতাম। সিপিএম প্রধান শত্রু হলেও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দেওয়াল লিখন চলত। হাসি-মস্করাও হত। সেই সব সম্পর্ক এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে।’’ তার কারণও ধরিয়ে দিচ্ছেন তিনি— ‘‘ভাবুন তো তখন কারা রাজনীতি করতেন, দুর্গাপদ সিংহ, আবদুস সাত্তার, বিজয় সিংহ নাহার, আজিজুর রহমান’’ দিন বদলে, এখন অন্ধকার জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাজনীতির, মান্নানের মুখে বিষন্নতা।

আশির দশকেও এই ‘ধার’ এই হিউমর বেঁচে ছিল বলে মনে করছেন অদ্যাপক সুগত সেন। বলছেন, ‘‘বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলাম, রাত জেগে দেওয়ালে ছড়া লিখছি। রাতের পর রাত জাগা। কোনও ক্লান্তি নেই। আসলে সেই তর্ক-বিতর্কগুলোই হারিয়ে গেছে।’’

কবি খালেদ নৌমান মনে করছেন, ‘‘মান হারিয়ে গেছে ভাই। এখন হালের লঘু বিষয় নিয়েও ছড়া কাটছে রাজনীতির কারবারিরা। আমার তো মনে হয়, আহামরি না হলেও মন্দের বাল ছিল ২০১১’র নির্বাচনে বাম সরকারের ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।’’ তারপর?

ফেসবুক-হোটাসঅ্যাপের চাকচিক্যে এখন খুব কষ্ট করে হাসা কিংবা গভীরতাহীন ভাঁড়ামোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা— এমনটাই মনে করছেন প্রবীণ এক বাম নেতা। বলছেন, ‘‘দুঃখটা কোথায় জানেন, বার বেড়ে গেছে রাজনীতির হারিয়েছে দার, হাল তাই এমন হয়েছে।’’

campaign election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy