শো-রুমের পিছনে ওয়ার্কশপ থেকে ভেসে আসছে পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ। বিগ্রহের সামনে বসে জনা পাঁচেক কর্মী। তাঁরাই সারছেন পুজোর টুকিটাকি কাজকর্ম। বাকি কর্মীরা বেজার মুখে কম্পিউটারের মুখ গুঁজে কাজ করে চলেছেন। তাদের দেখে বোঝারই উপায় নেই, বিশ্বকর্মা পুজো চলছে।
গত বছরেও এই দিনে কৃষ্ণনগরের এই গাড়ির শো-রুমে উৎসবের চেহারা ছিল। অঢেল খাওয়াদাওয়া। অনেক কর্মী এসেছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। অনেকটাই ‘গেট টুগেদার’-এর পরিবেশ। বুধবার তার বদলে নাম-কা-ওয়াস্তে পুজো। খানিক যেন বিষণ্ণতা। শালপাতার ছোট্ট প্লেটে ফল-প্রসাদ বিলি করতে করতে এক কর্মী বলেই ফেললেন, “পুজোর জাঁকজমক নিয়ে ভাবছি না। চাকরিটা এখনও আছে এটাই যথেষ্ট।”
বেশ কয়েক মাস ধরে গাড়ির বাজারে মন্দার যে কী সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে, তা যেন আগাম আঁচ করতে পারছেন নদিয়ার বিভিন্ন শো-রুমের কর্মীরা। কৃষ্ণনগরের এক শো-রুমের কর্মীর কথায়, “বিশ্বকর্মা পুজোর এই কাটছাঁট দেখে বুঝতে পারছেন না, আমরা ঠিক কী অবস্থায় আছি? তাই পুজোয় আনন্দ করতে আর মন সায় দিচ্ছে না।”
• সামগ্রিক মন্দার সরাসরি প্রভাব পড়ছে মফস্সল এলাকাতেও। • অনেকের ধারণা, জিএসটি কমে গেলে গাড়ির দাম কমে যাবে। • অনেকে মনে করছেন, মন্দার কারণে সংস্থা গাড়ির দাম কমাবে। • বৃষ্টি না হওয়ায় চাষেও মন্দা, মন্দা সার আর ট্রাক্টর ব্যবসাতেও। • বেসরকারি চাকুরেদের শো-রুমে দেখাই যাচ্ছে না।
কল্যাণী থেকে করিমপুর— প্রায় সর্বত্রই শো-রুমগুলোয় গাড়ি বিক্রির হার কমে গিয়েছে। কৃষ্ণনগর শহরের একটি প্রতিষ্ঠিত শো-রুম জানাচ্ছে, মাস সাত-আট আগেও ৬০টির মতো গাড়ি মাসে বিক্রি হত। এখন সেটা কমে ৫০-এ দাঁড়িয়েছে।
আবার রানাঘাটের একটি শো-রুম জানাচ্ছে, তাদের আগে মাসে ৩০-৩৫টার মতো গাড়ি বিক্রি হত, এ মাসে এখনও ২৩টার মতো হয়েছে। টেনেটুনে হয়তো ৩০-এ পৌঁছবেন, এই আশায় আছে তারা। শো-রুমের ম্যানেজার শুভ্রাংশু সেনগুপ্ত বলছেন, “গাড়ি বিক্রি অনেকটাই কমে গিয়েছে। গত বছর পুজোর মাসে ৫০টা গাড়ি বিক্রি হয়েছিল। এ বার ৩০টার বেশি তুলতে পারব কি না সন্দেহ।” তাঁর আশঙ্কা, “পুজোর মাসে যদি এই হয় তা হলে বাকি সময়ে কী হবে বুঝতে পারছেন?” এক গাড়ি সংস্থার তেহট্টের সেলস টিম লিডার বিপ্লব কুমারও বলছেন, “পুজোর মুখেও গাড়ির বিক্রি ভীষণ কম। টার্গেট পূরণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।”
কিন্তু কেন এই হাল?
গাড়ির ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলছেন, সামগ্রিক মন্দার সরাসরি প্রভাব পড়ছে মফস্সল এলাকাতেও। তবে আরও কয়েকটা কারণ সরাসরি প্রভাব ফেলছে গাড়ির বাজারে। তাদের কথায়, গাড়ির বড় অংশের খরিদ্দার হলেন ক্ষুদ্র শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী। তাঁদের অনেকেরই ধারণা, জিএসটি কমে গেলে গাড়ির দাম কমে যাবে। দু’দিন অপেক্ষা করে গাড়ি কেনাই ভাল। অনেকে মনে করছেন, মন্দার কারণে সংস্থাগুলো গাড়ির দাম কমাতে বাধ্য হবে। তখন সস্তায় গাড়ি কেনা যাবে।
কৃষ্ণনগরের একটি শো-রুমের ম্যানেজার শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলছেন, “গাড়ি বিক্রি কমার একটা বড় কারণ হয়তো বৃষ্টি না হওয়া। যে বড় চাষিরা হয়তো গাড়ি কিনতেন, তাঁরা কিনতে পারছেন না। মন্দা সার আর ট্রাক্টর ব্যবসাতেও।” সবচেয়ে প্রভাব পড়েছে অবশ্য বেসরকারি চাকুরেদের ক্ষেত্রে। তাঁদের শো-রুমে দেখাই যাচ্ছে না।
কৃষ্ণনগরের শো-রুমের ম্যানেজার বলছেন, “বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মীদের চাকরির অনিশ্চয়তা কাজ করছে। যাঁরা মাসিক কিস্তিতে গাড়ির কেনার মতো বেতন পান, তাঁরাও গাড়ি কিনছেন না। হয়তো তাঁদের মনে ভয় কাজ করছে, চাকরি চলে গেলে কিস্তি শোধ করব কী করে!” শুভ্রাংশু বলেন, “এখন আমাদের গাড়ির ব্যবসা তো দাঁড়িয়ে আছে সরকারি চাকুরেদের উপরে, যাঁদের মাসমাইনে নিশ্চিত।”
সঙ্কট কী ভাবে ক্রমশ ঘনিয়ে উঠছে, বিশ্বকর্মা পুজো যেন সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল।