Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
দুয়ারে দোল: গান

মৃদঙ্গ থইয়া থইয়া, সুরজ্যোৎস্না চরাচরে

সেই ১৯৮১ থেকে দোলের দিন এ দেশের সমবেত সঙ্গীত হয়ে দাঁড়ায় বিগ-বি কণ্ঠে ভাঙ-মাতলা নিষিদ্ধতার সিলসিলা— ‘রঙ্গ বরসে ভিগে চুনরবালি’।

সঙ্গত: দোলের ভক্তি-গানে শ্রীখোল ছাড়া গতি নেই। নবদ্বীপের পথে। —নিজস্ব চিত্র।

সঙ্গত: দোলের ভক্তি-গানে শ্রীখোল ছাড়া গতি নেই। নবদ্বীপের পথে। —নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভাশিস সৈয়দ
নবদ্বীপ ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৭ ০০:২২
Share: Save:

সেই ১৯৮১ থেকে দোলের দিন এ দেশের সমবেত সঙ্গীত হয়ে দাঁড়ায় বিগ-বি কণ্ঠে ভাঙ-মাতলা নিষিদ্ধতার সিলসিলা— ‘রঙ্গ বরসে ভিগে চুনরবালি’।

হরিবংশ রাই বচ্চনের লেখা আর শিব-হরির সুরে বাঁধা ওই বলিউডি গানের বাইরেও দোলের বহুবর্ণ গান ছিল এ দেশে, এ বঙ্গেও। রবিঠাকুরের শান্তিনিকেতন-ঘেঁষা বসন্তোৎসব গত আধ শতকেরও বেশি ধরে ‘খোল দ্বার খোল’ বয়ে চুঁইয়ে মিশেছে বাঙালির ধমনীতে। তবে তার বাইরেও ছিল, আছে হরেকরকম।

‘‘সে কালে রাজা বা জমিদারবাবুর বৈঠকখানায় দোলের সকালে গানের আসর গাওয়া হত হোরি ঠুমরি যেমন তেমনই গাওয়া হত, তেমনই ছিল বাংলা গান যার বেশির ভাগ রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক,’’ বলছিলেন নবদ্বীপের জানান নীতীশ রায়। পরে ছায়াছবির গান এল। যেমন ‘মঞ্জরী অপেরা’ ছবিতে শুদ্ধবসন্ত রাগে গাওয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান, ‘আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে/ একলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে’ বা ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির ‘আবিরে রাঙালো কে আমায়’— মনে করালেন শান্তিপুরের শিক্ষক অকৈতব মৈত্র। আর, আটের দশকে আশা ভোঁসলের কণ্ঠে ‘একান্ত আপন’ ছবির ‘খেলব হোলি রং দেব না” তো এখনও শোনা যায়।

বছর পঞ্চাশ আগেও বহরমপুর শহরে ইমারতের এত ভিড় হয়নি। ইন্দ্রপ্রস্থ এলাকা সবে মাথা তুলছে। শহরে দোল বলতে তখন বনবিহারী সেন ওরফে হরিবাবুর দোল। আর ও দিকে, রাধারঘাটে মোহমোহন সেনের তপোবন আশ্রমেও জাঁকজমক করে দোল হত। প্রবীণ সাবিত্রীপ্রসাদ গুপ্ত জানান, তপোবনের অনুষ্ঠানে বহু গণ্যমান্য আসতেন। সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত গান-বাজনা চলত। গোরাবাজারে এখন যেখানে বাপুজি পাঠাগার, সেখানে একটি ধর্মশালা ছিল। ভাগীরথীর পাড় লাগোয়া ওই ধর্মশালায় দোতলার ঘরে জমজমাট গানের আসর বসত। তবলাবাদক সত্যনারায়ণ সাহা ওরফে গুণ্ডাদা তাঁর দলবল নিয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসাতেন। কাশিমবাজারের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষও তার টান কাটাতে পারতেন না। সৈয়দাবাদ কুঞ্জঘাটা রাজবাড়ি ও কাশিমবাজার রাজবাড়ির নিজস্ব দোলেও সন্ধ্যায় ভক্তিমূলক ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আয়োজন থাকত। সেখানে ভিড় করতেন এলাকার সর্বস্তরের মানুষ।

দোলের গান বলতে মূলত বসন্ত বন্দনা। সম্পন্ন পরিবারগুলির বাইরে সাধারণ নাগরিকেরা চিরকালই দোল বরণ করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের গানে। সে কালেও আবির নিয়ে নৃত্যগীত সহকারে নগর পরিক্রমা করত বেশ কয়েকটি সংস্থা। পাড়ায়-পাড়ায় নাচগানের অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গে আধুনিক গান, মায় বাংলা ছবির গানও শোনা যেত অনেক মহল্লায়।

সেই ধারা এখনও চলছে। এবং এখনও তার সর্বাগ্রে সেই ‘খোল দ্বার খোল’। নবদ্বীপে বেশ কয়েক বছর ধরেই দোলের দিন সকালে সাংস্কৃতিক কর্মীরা পরিক্রমায় বেরোন। ‘ওরে গৃহবাসী’ দিয়ে শুরু আর ‘রঙ্গ বরসে’ দিয়ে শেষ। মাঝে কীর্তন ভাটিয়ালি আধুনিক ছায়াছবি। বহরমপুর নবপল্লি পাঠবিতান প্রাথমিক স্কুলে তো এক স্থানীয় সঙ্গীত স্কুলের প্রায় আড়াইশো ছেলেমেয়ে ‘খোল দ্বার খোল’ গেয়ে শ’তিনেক মিটার নেচে এসে মঞ্চে ওঠে। ঠিক হয়েছে, ‘মধুর বসন্ত এসেছে’ শিরোনামে প্রকৃতি পর্যায়ের গান আর বসন্ত অনুসঙ্গ কিছু প্রেমের গানও এ বার গাওয়া হবে। একটি নাচ শেখানোর স্কুল আবার ইন্দ্রপ্রস্থ মোড় থেকে রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত রঙ খেলা আর নাচগানের পরিকল্পনা করেছে।

প্রবীণ কীর্তনিয়া সরস্বতী দাসের মতে, দোলের রং লুকিয়ে থাকে বসন্ত কীর্তনের সুরের মাঝে। তাই বৈষ্ণব ভজনকুটিরে দোলের গান ভাসে অন্য ভাবে। দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় গঙ্গার তীর ঘেঁষা সরস্বতী দাসের ছোট ভজনকুঠির নিকোনো উঠোনে প্রতি বছরই বসে বসন্তকীর্তনের আসর। শুধু রসিক শ্রোতার আমন্ত্রণ সেখানে।

আড়বাঁশির সুরে মৃদঙ্গ বাজছে ‘তিন চার তিন চার’ ছন্দের ‘দোঠুকি’ তালে। কীর্তন রসভারতী সরস্বতী দেবী গলা মেলালেন, ‘গাওত কত রস প্রসঙ্গ বাজত কত বীণ/ মৃদঙ্গ থইয়া থইয়া মৃদঙ্গিয়া।’ তার পরে আখর দিলেন ‘মৃদঙ্গ বাজছে তা তা থুইয়া, তা তা থুইয়া।’ পূর্ববঙ্গে ‘থুইয়া’ শব্দের অর্থ ‘রেখে দেওয়া’। কৃষ্ণসেবায় অদরকারি যে সব জিনিস তা রেখে দিয়ে বা ত্যাগ করে হোলি খেলতে এসো। অন্তর-বাহির কৃষ্ণভক্তির পাকা রঙে রাঙিয়ে নাও। ভক্তের সঙ্গে ভগবানের এই নিরন্তর হোরিখেলা।

আসর ঢলে চাঁদ যখন শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, ঋদ্ধ কীর্তনিয়ার কণ্ঠে ভর করেছেন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্ম— রবীন্দ্রনাথ। চোখটি বুজে সরস্বতী গাইছেন— ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা, প্রিয় আমার ওগো প্রিয়...।’

চরাচর ভেসে যাচ্ছে সুরের জ্যোৎস্নায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Evolution Of Holi Songs Basanta Utsav Holi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE