খড়ের চালা আর বেড়ার দেওয়াল দেওয়া ঘরটা বছর দেড়েক আগের বর্ষায় হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছিল। তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিবেশীর বাড়ি মাথা গুঁজে ছিলেন লালগোলা-কৃষ্ণনগর শাখার ট্রেনে ট্রেনে লজেন্স, বাদাম, ডালমুট ফেরি করা তাহাজুল হক।
শেষে পরিজনদের থেকে টাকা ধার করে বাবার দেওয়া এক কাঠা জমিতে পাঁচ ইঞ্চির ইটের গাঁথনি, মাথায় টিনের চাদর চড়িয়ে, মাটির মেঝেয় কোনও মতে মাথা গুঁজেছেন লালগোলা রাধাকান্তপুরের তাহাজুল। এমন পরিবারের মেয়ে কলা বিভাগে শতকরা ৮৫ ভাগ নম্বর পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলে খুশির ঢল নামারই কথা। কিন্তু আনন্দের বদলে দুশ্চিন্তার পাহাড় ভেঙেছে পরিবারে প্রথম উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ তসলিমা নাসরিনের মাথায়।
রাধাকান্তপুরের পাশের গ্রাম বালুটুঙি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থেকে উত্তীর্ণ তসলিমার ইচ্ছে, ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বিএ পড়ার। তার মা রোজিনা বিবি বলেন, ‘‘মেয়ে এত দিন গ্রামের স্কুলে পড়েছে। গ্রামের কোচিং সেন্টারে নিখরচায় টিউশন নিয়েছে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বই দিয়ে, সময়ে-অসময়ে মেয়েকে লেখাপড়া দেখিয়ে সাহায্য করেছেন। তার উপরে দূরের কলেজ! খরচ কী করে জুটবে?’’
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া রোজিনা আর সপ্তম শ্রেণি পাশ তাহাজুলের তিনটিই মেয়ে। নিজেরা মাধ্যমিকের চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছতে না পারলেও তিন মেয়েকেই কলেজ পর্যন্ত পড়াবেন বলে জেদ ধরেছেন তাঁরা। তসলিমা ৪২৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল সবে। মেজো মেয়ে তনুজা পারভিন এ বারই মাধ্যমিক পাশ করেছে। ছোট মেয়ে তাজমিরা খাতুন এখন দশম শ্রেণিতে পড়ছে।
তসলিমা বলে, ‘‘সারা দিন ট্রেনে ফেরির পর রাতে আব্বু বাড়ি ফেরেন কাঁচা মাল কিনে। আমরা রাতে তিন বোন সেই মাল প্যাকেটে ভরে দিই। সকালে আব্বু মাল নিয়ে ট্রেনে চলে যান। এ বার থেকে আমরা আরও বেশি করে খাটব।’’
বছর দুয়েক আগে শল্য চিকিৎসার পরে বেশ অসুস্থ রোজিনা। তাহাজুল বলেন, ‘‘ওর চিকিৎসার নিয়মিত খরচ আছে। ঘর তৈরির ধারের টাকা শোধ করতে পারিনি এখনও। মাটির মেঝে, টাকার অভাবে জানলাও লাগাতে পারিনি। কিন্তু তাও মেয়ের ফল দেখেই পড়ানোর জেদ বেড়ে যাচ্ছে, জানেন!’’
বালুটুঙি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক আব্দুল আরাফত বলেন, ‘‘তসলিমার মতো নম্র, মেধাবী ছাত্রী বেশি মেলে না আমরা আছি। ওর লেখাপড়ার স্বপ্ন শেষ হতে দেব না।’’