Advertisement
০৮ মে ২০২৪
নবদ্বীপ

ছুটি চাইতেই দাবি ঘুষ, না দিতেই মার

তাঁর বাড়ি নবদ্বীপে। বাবা-মা অসুস্থ। বাড়িতেই থাকেন। বাড়িতে স্ত্রী ও ছোট ছেলেও রয়েছে। পারিবারিক এই অবস্থার মধ্যে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে রাজ্য দমকল বাহিনীতে যোগ দেন ৩৫ বছরের গদাধর হালদার। তখন থেকেই কলকাতায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩৫
Share: Save:

তাঁর বাড়ি নবদ্বীপে। বাবা-মা অসুস্থ। বাড়িতেই থাকেন। বাড়িতে স্ত্রী ও ছোট ছেলেও রয়েছে।

পারিবারিক এই অবস্থার মধ্যে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে রাজ্য দমকল বাহিনীতে যোগ দেন ৩৫ বছরের গদাধর হালদার। তখন থেকেই কলকাতায়। চাইলেও সব সময়ে ছুটি পান না। বাবা-মার অসুস্থতার কারণে সমস্যায় পড়ে যান। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে বদলির জন্য মাস ছয়েক আগে কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন গদাধর।

ভয়ঙ্কর এক অভিযোগ নিয়ে সেই গদাধর এখন শয্যাশায়ী। অভিযোগ, যাঁদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন, তৃণমূল প্রভাবিত কর্মী সংগঠনের সেই চার নেতা বদলি করানোর আশ্বাস দিয়ে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। সেই টাকা গদাধর দিতে না চাওয়ায় তাঁকে দমকলের দেওয়া কোমরের মোটা বেল্ট দিয়ে বেধড়ক মারা হয়। এবং ঘটনাটি ঘটে খাস কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারের ভিতরে! সেখানে দমকলের ইউনিটের একটি ঘরে বেধড়ক মারধর করে সারা রাত সেই ঘরে গদাধরবাবুকে আটকেও রেখে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

ঘটনাটি নিয়ে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে দমকল। দমকলের ডিজি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কর্তব্যরত অবস্থায় যে ভাবে দমকলের এক কর্মীকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে,
তা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। বিভাগীয় তদন্ত চলছে। তা ছাড়া, অভিযুক্ত চার কর্মীকে উত্তরবঙ্গে বদলি করা হয়েছে।’’

গত ১০ নভেম্বর রাতে লালবাজার দমকল কেন্দ্রে এই ঘটনার পরদিন সকালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় গদাধরকে ভর্তি করা হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর এখন নবদ্বীপের বাড়িতে রয়েছেন গদাধরবাবু। এখনও বাঁ চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। শনিবার চক্ষু বিশারদদের পরামর্শ নিয়েছেন।

মারধরের ঘটনাটি গড়িয়েছে পুলিশ পর্যন্ত। গত ১২ নভেম্বর হাসপাতালে গিয়ে গদাধরবাবুর বয়ান নিয়ে আসেন হেয়ার স্ট্রিট থানার পুলিশ অফিসারেরা। তার ভিত্তিতেই অভিযুক্ত ওই চার কর্মীর বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করেছে পুলিশ। এই খবর পেয়ে অভিযুক্ত চার কর্মী রমিত ঘোষ, মনোজ বিশ্বাস, নবরঞ্জন মণ্ডল, শুভ মজুমদার গত ১৬ নভেম্বর ব্যাঙ্কশাল আদালত থেকে আগাম জামিনও নিয়ে নিয়েছেন। রমিত তৃণমূল প্রভাবিত ওয়েস্টবেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের উত্তর কলকাতার সম্পাদক। মনোজ সংগঠনের লালবাজার শাখার ইউনিট সেক্রেটারি। বাকি দু’জন সংগঠনের সদস্য।

ঠিক কী ঘটেছিল?

গদাধরবাবুর কথায়, ‘‘বাড়ির কাছাকাছি বদলির জন্য রমিত ও মনোজকে জানালে ওঁরা আমার কাছে ৫০,০০০ টাকা চেয়েছিলেন। আমি টাকা দিইনি। গত ৮ নভেম্বর ওরা ফের আমার কাছে কুড়ি হাজার টাকা চায়। আমি রাজি ছিলাম না। ওরা তাই আমার উপরে নানা ভাবে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা শুরু করে।’’

গত ১০ নভেম্বর রাতে লালবাজারে ডিউটিতে যান গদাধরবাবু। তাঁর অভিযোগ, আগের দিন নবরঞ্জন তাঁকে ফোন করে টাকা নিয়ে আসতে বলেন। তিনি টাকা নিয়ে যাননি। গদাধরবাবু জানিয়েছেন, তিনি ডিউটিতে থাকাকালীন রাত প্রায় ১১টা নাগাদ রমিত ও মনোজ টাকা দাবি করেন। তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করলে রমিত, মনোজ নিজের অফিসের পোশাকের বেল্ট খুলে তাঁকে মারতে থাকে।

গদাধরবাবুর কথায়, ‘‘রমিত, মনোজ মারতে মারতে আমাকে দোতলায় রিক্রিয়েশন ক্লাব রুমে নিয়ে যায়। ওই ঘরে তখন নবরঞ্জন ও শুভ ছিল। ওরা চার জন মিলে আমার পেটে, বুকে, মুখে ক্রমাগত লাথি ও ঘুষি মারতে থাকে। শুভ একটা ভাঙা বোতল নিয়ে আমার পেটে আঘাত করতে চেয়েছিল। বাধা দিতে গেলে আমার হাত কেটে যায়।’’ অভিযোগ, সেই সময়ে লালবাজারের ওই ইউনিটের দায়িত্বে থাকা অফিসার সুবীর ঘোষ গোটা ঘটনাটি কাছ থেকে দেখলেও, গদাধরবাবু সাহায্য চাওয়া সত্ত্বেও চুপ করে ছিলেন।

পুলিশকে গদাধরবাবু জানান, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মারধরের পরে ওই ক্লাব ঘরে তাঁকে আটকে রেখে চার জন বেরিয়ে যান। গদাধরবাবুর কথায়, ‘‘আমার কোনও জ্ঞান ছিল না। গভীর রাতে জ্ঞান ফিরতে আমি ক্লাবরুম থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে পালানোর চেষ্টা করি। গেট দিয়ে বেরোতেই ওরা আমাকে দেখে ফেলে। আমাকে রমিতরা টানতে টানতে ফের উপরে নিয়ে গিয়ে ক্লাব রুমে আটকে বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে দেয়।’’

গদাধরবাবুর অভিযোগ, ওই ঘরে সারারাত ওই অবস্থায় কাটানোর পরে ভোর চারটে নাগাদ ডিউটি শুরুর কিছুক্ষণ আগে ওই চার জন দরজা খুলে তাঁকে টেনে নীচে নিয়ে গিয়ে ডিউটি করতে বলেন। লালবাজার ফায়ার স্টেশনের ওসি তাপস কুরেশি সকাল ন’টা নাগাদ অফিসে ঢুকে গদাধরবাবুকে আহত অবস্থায় এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকতে দেখেন। গোটা ঘটনার কথা জানতে পেরে গদাধরবাবুকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন তিনিই।

দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে, নবরঞ্জন ও শুভ লালবাজার ফায়ার স্টেশনের কর্মী নন। নবরঞ্জন দমকলের সদর দফতরের ও শুভ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ফায়ার স্টেশনের কর্মী। নবরঞ্জন আবার তৃণমূল সংগঠনের সেন্ট্রাল কমিটির অফিস সেক্রেটারিও। এই দু’জন লালবাজার দমকল ইউনিটের কর্মী না হওয়া সত্ত্বেও কী ভাবে রাতে সেখানে ঢোকার অনুমতি পেলেন? লালবাজারের ফায়ার স্টেশনের ওসি তাপস কুরেশি বলেন, ‘‘আমি ১০ তারিখ রাতে ঘটনার সময়ে ছিলাম না। ওই সময়ে স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন সুবীর ঘোষ। দুই বহিরাগতকে অফিসে ঢুকতে দেওয়ার জন্য সুবীরবাবুকে শোকজ করা হয়েছে।’’

তৃণমূল পরিচালিত এই সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক অরূপ রায় বলেন, ‘‘ঘটনাটি অত্যন্ত নিন্দনীয়। অভিযুক্ত চার জনকে সংগঠনের তরফে শো-কজ করা হয়েছে। তার যথাযথ জবাব না পেলে তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হবে।’’ যদিও ঘটনার কথা অস্বীকার করে অভিযুক্ত রমিত ঘোষ বলেন, ‘‘মিথ্যা অভিযোগ। আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হয়েছে।’’ বাকি তিন জনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও পাওয়া যায়নি। মোবাইলে পাঠানো বার্তারও জবাব দেননি তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bribe Fire Brigade
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE