Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ভুল করেই হাঁক দিয়ে ফেলেন, ‘মাছ চাই গো’

দেড় দশক আগেও রাত-জাগা পদ্মা থেকে নৌকার খোল ভরিয়ে ঘাটে ফিরতেন তাঁরা, সেই মাছ-হারা নদী থেকে মুখ ফিরিয়ে অনেকেই এখন গাঁ-গঞ্জে হরেক মালের ফিরিওয়ালা, খোঁজ নিল আনন্দবাজারজলঙ্গি এবং রানিনগর সীমান্তে এই সমস্যাটা প্রকট হয়েছে বছর কুড়ি ধরে। শেষ সম্বল নৌকা-জাল হারিয়ে অনেকেই পাড়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে। বাপ-দাদাদের মতো আর ভুল করেননি তাঁরা। নতুন প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান খুঁজেছেন পদ্মাপাড় থেকে অনেক দূরের শহরে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

সুজাউদ্দিন বিশ্বাস
জলঙ্গি শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৪৪
Share: Save:

ভিটেবাড়ি উজিয়ে চাষের জমি, এমনকি বাড়ির লাগোয়া বাগানটাও খেয়ে ফেলেছিল পদ্মা। শুধু গিলতে পারেনি তার আলকাতরা মাখা মস্ত নৌকা আর গোটা কয়েক ছেঁড়া জাল।

টিকটিকিপাড়া গ্রামের নরেন মণ্ডল সেই নৌকা আর জাল নিয়ে ভেসে পড়তেন পদ্মায়। সব কেড়ে নিয়েও সেই পদ্মাও তাঁকে ফের মাছ-ভাতের পাত পেড়ে দিয়েছিল।

তবে, নদী তো উন্মাদিনীর মতো! স্বপ্ন দেখিয়ে সে আবার সরে গিয়েছিল দূরের খাতে। তার পরে এক সময় সেঁদিয়ে গিয়েছে পড়শি দেশের গাঁ গঞ্জে। আর তার খাত বদলের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে মাছ-মাছালি।

সেই নৌকা আর জালে এখন মাকড়সার পরিপাটি সংসার। নতুন করে পেশা খুঁজছেন নরেনরা।

জলঙ্গি এবং রানিনগর সীমান্তে এই সমস্যাটা প্রকট হয়েছে বছর কুড়ি ধরে। শেষ সম্বল নৌকা-জাল হারিয়ে অনেকেই পাড়ি দিয়েছেন ভিন রাজ্যে। বাপ-দাদাদের মতো আর ভুল করেননি তাঁরা। নতুন প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থান খুঁজেছেন পদ্মাপাড় থেকে অনেক দূরের শহরে।

ভাঙন বদলে দিয়েছে ঠিকানা, ভাঙনের পরে নরেন মণ্ডল তাই টিকটিকিপাড়া ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছেন জলঙ্গির কাজিপাড়ায়। এখন তাঁর পরিচয় রংমিস্ত্রি। ঠিকানা কেরলের কোচি। মাস গেলে টাকা নিয়ে ঘরে ফেরেন। এক বার নদীর চরে গিয়ে দাঁড়ান, তার পরে বিড়বিড় করেন, ‘‘একটা সময় বাপ দাদা হাতে করে পদ্মায় নামিয়েছিল। সেখান থেকেই পালাতে হল!’’

গ্রামে ফিরলে মাচায় বসে বন্ধু-পড়শিদের সঙ্গে গল্প করেন— ‘‘আমাদের মাছ ধরা শিখিয়েছিলেন বাপ-ঠাকুরদা। খুব ছোটবেলা থেকেই জানতাম, এটাই আমাদের রুজি-রুটির একমাত্র পথ। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল অনেক কিছু, হারিয়ে গেল ঠিকানা সরে গেল পদ্মাও। আর সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল মাছ।’’

নরেনের মতো অনেকেই আছেন যাঁরা নৌকার হাল ছেড়ে কেউ রং-তুলি নিয়ে রাজমিস্ত্রি, কেউ হাতুড়ি গাঁইতি নিয়ে দালান গড়ছেন ভিন্্ রাজ্যে। শিরচরের নির্মল মণ্ডল, গণেশ মণ্ডল মাছ-হারা পদ্মা থেকে মুখ ফিরিয়ে এখন কেরলে এমনই কাজ করছেন। বলছেন, ‘‘কী করব বলুন তো, মাছের দেখা নেই, সঙ্গে দোসর বিএসএফের নানা ফতোয়া। বিজিবি’র জাল কেড়ে নেওয়া, পেট ভরবে কী করে!’’

শিরচরের অমৃত মণ্ডল বলছেন, ‘‘হাজারও সমস্যার মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষের পেশাটাই চালিয়ে যাচ্ছিলাম এত দিন, কিন্তু প্রণব কাকাকে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং বিএসএফ-বিজিবি’র সম্পর্ক তেঁতো হয়ে যাওয়ায় আর সাহস পাচ্ছি না, এ বার মনে হয় আমাকেও পাড়ি দিতে হবে ভিন্্ রাজ্যে।’’

গুড়িপাড়ার প্রশান্ত মণ্ডল বলছেন, ‘‘গাঁ গঞ্জে হরেক মাল পাঁচ টাকা, ফিরি করে বেড়াই। তবে জানেন, এখনও ভুল করে ‘মাছ চাই গো বলে হাঁক দিয়ে ফেলি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Profession Fishermen Padma river Jalangi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE