Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

‘কিছু চাই না, একটা চাকরি দিন’

রাজ্য কবাডি দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে ১৯৯৭ সালে নৃপেন ত্রিপুরার মাঠ কাঁপিয়েছিলেন। সেকথা কথা জানেনই না তাঁর সঙ্গী টোটোচালকদের কেউ-ই। চূড়ান্ত হতাশায় নিজেকে তিনি এমনই গুটিয়ে রাখেন যে, শুনলেও হয় তো তাঁরা বিশ্বাস করবেন না।

টোটোয় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন নৃপেন। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

টোটোয় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন নৃপেন। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

অনল আবেদিন
বহরমপুর শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৯ ০০:৫৪
Share: Save:

একদা বিপক্ষ দলের কবাডি খেলোয়াড়কে জাপটে ধরে অবলীলায় আটকে দিতেন নিজেদের কোর্টে। অবস্থার ফেরে সেই হাতজোড়া এখন টোটোর ‘হ্যান্ডল’-এর ‘গ্রিপ’-এ আটকে পড়েছে। একদা জাতীয় স্তরের কবাডির মাঠে পা জোড়া হরিণের মতো ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে বেড়িয়েছে। সেই দুরন্ত পা জোড়া এখন চূড়ান্ত অভিমানে প্রায় স্থবির অবস্থায় টোটোর পাদানিতে পড়ে থাকে। তিনি একদা বাংলা কবাডি দলের অধিনায়ক নৃপেন থান্দার।

রাজ্য কবাডি দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে ১৯৯৭ সালে নৃপেন ত্রিপুরার মাঠ কাঁপিয়েছিলেন। সেকথা কথা জানেনই না তাঁর সঙ্গী টোটোচালকদের কেউ-ই। চূড়ান্ত হতাশায় নিজেকে তিনি এমনই গুটিয়ে রাখেন যে, শুনলেও হয় তো তাঁরা বিশ্বাস করবেন না। ত্রিপুরার মাঠে সর্বভারতীয় স্তরের খেলায় পঞ্জাবের সঙ্গে তাঁদের লড়াই আজও কবাডিপ্রেমীদের মনে আছে। সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন নৃপেনরা। কিন্তু কবাডির জন্য জীবন ‘ বাজি’ রাখলেও বিনিময়ে কিছুই পাননি তিনি। অভিমানে ও দুঃখে তাঁর সহ-চালকদের কাছে অতীতের সেই স্বর্ণোজ্জ্বল দিনের কথা বলেন না তিনি। নৃপেনের গলায় অভিমান। ‘‘স্রেফ শরীর সম্বল করে জেলা ও রাজ্যের মান বাঁচানোর জন্য এক যুগ ধরে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছি। সেই লড়াই আমাকে দারিদ্য ছাড়া আর কী দিয়েছে বলুন তো?’’

রাজ্য যুব উৎসবে খেলার সুবাদে জাপানে খেলতে যাওয়া ভারতীয় দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন নৃপেন। সেটা ২০০৮ সালের কথা। নৃপেন বললেন ‘‘সেই বার ভারতীয় দলের হয়ে জাপানে খেলতে যাওয়ার কথা ছিল আমার। জাতীয় দলে এ রাজ্য থেকে কেবল আমিই নির্বাচিত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই খবরটা পর্যন্ত আমাকে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি কেউ। যখন জানতে পারলাম, তখন ভারতীয় দল জাপানে খেলতে চলে গিয়েছে। সেই থেকে খেলাটাই ছেড়ে দিয়েছি।’’

কান্দির দুর্গানগর গ্রামের দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান নৃপেনের কবাডি খেলার শুরু স্কুল জীবনে। নিজের ক্রীড়া নৈপুণ্যের জন্য তিনি ব্লক থেকে মহকুমা, মহকুমা থেকে জেলা দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালে বনগাঁয় আন্তঃজেলা কবাডিতে রানার্স হয়েছিল মুর্শিদাবাদ। ফাইনালে হেরে গেলেও গোটা টুর্নামেন্টে দর্শকদের নজর কেড়েছিলেন নৃপেন। পরের বার চন্দননগরের খেলায় পুরুলিয়াকে হারিয়ে নৃপেন থান্দারের মুর্শিদাবাদ জেলা দল রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০৭ সালে রাজ্য দলের অধিনায়কত্ব পান নৃপেন। ২০০৫ সালে রাজ্যস্তরের মহিলা কবাডি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কান্দির মাঠে। সেই টুর্নামেন্টে রেফারি ছিলেন উচ্চমাধ্যমিক অনুত্তীর্ণ নৃপেন। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘খেলায় দক্ষতার সরকারি স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও আমার মতো হতদরিদ্রের কপালে একটা সরকারি চাকরি জুটল না! শেষ পর্যন্ত সংসার চালাতে টোটো চালানো শুরু করলাম। সেই টোটো কিনতেও আর্থিক সাহায্য করেছিল এক বন্ধু। কিস্তিতে তাকে টাকা শোধ দিতে হয়। বছর তিনেক হল কান্দি থেকে আমাকে বহরমপুরে পাড়ি দিতে হয়েছে এ জন্য। পুরনো কথা বন্ধুদের বলতে লজ্জা পাই। কিছু চাই না। একটা চাকরি দিন।’’

মুর্শিদাবাদ জেলা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সম্পাদক জগন্ময় চক্রবর্তী দীর্ঘদিন ধরে চেনেন নৃপেনকে তিনি বললেন, ‘‘কান্দির বিবেকানন্দ পাঠচক্রে নিয়মিত অনুশীলন করত নৃপেন। আমাদের চোখের সামনেই ও কবাডি খেলোয়াড় হিসেবে নাম করল। একটা সরকারি চাকরি ওর পাওয়া উচিত ছিল।’’ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক বিশ্বজিৎ ভাদুড়ীর কথায়, ‘‘রাজ্য দলের প্রাক্তন অধিনায়ককে অর্থাভাবে টোটো চালিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে, এ লজ্জা খেলাধুলোর সঙ্গে যুক্ত সকলের। আমি ওঁর চাকরির জন্য প্রশাসনের কাছে অবশ্যই তদ্বির করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kabaddi Player Toto Driver
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE