সংরক্ষণের দাবি উঠছে পোড়ামাতলা জগদ্ধাত্রীর মতো প্রাচীন মূর্তিগুলির। —নিজস্ব চিত্র।
নদীর বুকে জেগে ওঠা নতুন দ্বীপ বা নবদ্বীপ শুধু এক স্থাননাম নয়। ইতিহাসের ডাউন মেমোরি লেন ধরে রোমাঞ্চকর এক পথ চলার নাম নবদ্বীপ। সে চলায় কখনও সঙ্গী বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর। কখনও তুর্কি হানাদার বখতিয়ার খলজি কিংবা বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন। এ পথেই দেখা মিলবে বাসুদেব সার্বভৌম বা স্বয়ং চৈতন্যদেবের। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, রঘুনাথ শিরোমণি হয়ে এই পথ মিশেছে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গড়ে তোলা সমকালীন বৃহৎ বঙ্গের অন্যতম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে।
এ হেন নবদ্বীপে এখন প্রাচীনত্বের নিদর্শন খুঁজে পাওয়াই ভার। নতুন নবদ্বীপ যেন পণ করেছে, যা কিছু অতীত সে সব জলাঞ্জলি দিতে হবে। আকাশছোঁয়া কিছু বাড়ি আর শপিংমলই নাকি আধুনিকতার একমাত্র নিদর্শন। তাই শহরের প্রাচীন বাড়ি, নাটমন্দির ভেঙে গড়ে উঠছে একের পর এক বহুতল। ক্রমশ কমে আসছে প্রাচীন নির্মাণের সংখ্যা।
হাতে গোনা কিছু স্মারক এখনও টিঁকে আছে। যার মধ্যে অন্যতম ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত বড় আখড়া। এটি চৈতন্য-পরবর্তী নবদ্বীপের প্রথম বৈষ্ণব আখড়া। নবদ্বীপে ন্যায়ের পাঠ নিতে আসা দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ তোতারাম দাস একসময় প্রবল বৈষ্ণব অনুরাগী হয়ে ওঠেন। তিনিই গড়ে তোলেন বড় আখড়া। গঙ্গার ভাঙনে চৈতন্যদেবের বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেলে তোতারামের চেষ্টায় ১৭৮৮ সালে তৈরি হয় মহাপ্রভু মন্দির। ‘পীঢ়ারীতি শৈলী’তে গড়া একচূড়া এই মন্দির বর্তমানে নবদ্বীপের সবচেয়ে প্রাচীন চৈতন্যমন্দির।
১৮২৩ সালে মহারাজ গিরিশচন্দ্র নবদ্বীপে নির্মাণ করান বাংলার বিরল অষ্টকোণাকৃতি শিবমন্দির। এর পর ১৮৬৯ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন হরিসভা মন্দির স্থাপন করেন। এই সব ঐতিহ্যবাহী সৌধও খুব নিরাপদ নয়। সরকারি কোনও উদ্যোগ আজ পর্যন্ত নবদ্বীপের কোনও সৌধ সংরক্ষণের জন্য নেওয়া হয়নি। বরং প্রোমোটারের হাতুড়ির ঘায়ে গুঁড়িয়ে গিয়েছে কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত শঙ্কর ন্যায়তীর্থের তিন খিলানের দুর্গামণ্ডপ। মহামহোপাধ্যায় অজিতনাথ ন্যায়রত্নের টোলবাড়ি শ্রীচৈতন্য চতুষ্পাঠী, পোড়াঘাটের তোরণ।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, ‘‘গুরুত্ব অনুসারে নবদ্বীপের বিভিন্ন মন্দিরের ক্রমতালিকা আমরা হেরিটেজ কমিশনকে দিয়ে আবেদন জানিয়েছিলাম, যাতে সেগুলির সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কিছুই হয়নি।”
গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সহ সভাপতি কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী বলেন, “নবদ্বীপের মতো শহরের ঐতিহ্যবাহী যা কিছু, সবই ব্যক্তিগত উদ্যোগে টিঁকে আছে। কিন্তু হাজার বছরের ইতিহাসকে এ ভাবে জোড়াতালি দিয়ে কতদিন ধরে রাখা যাবে, জানি না।’’ তবে তাঁর আশা, হেরিটেজ শহর হিসাবে নবদ্বীপ ঘোষিত হলে এই বিবর্ণ ঐতিহ্য উপযুক্ত ভাবে রক্ষা করা যাবে।
প্রশ্ন উঠেছে, কেন নবদ্বীপের ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না? অথচ, ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ নবদ্বীপে এসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায় প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে নবদ্বীপকে হেরিটেজ শহর বলে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই নিয়ে কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
বর্তমানে কী অবস্থা নবদ্বীপের হেরিটেজ সিটি প্রকল্পের? উত্তরে নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, “আমাদের তরফে যাবতীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে। এখন চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষায় আছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy