পথ দখল করেছে দোকান। — নিজস্ব চিত্র
পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে মাটির ঘর। দুপুরে রাঁধা ভাত পুড়ে ছাই। অভুক্ত শিশুকে কোলে নিয়ে দাওয়ায় বসে রয়েছেন মা। চোখে শূন্যদৃষ্টি। পিছনে দাঁড়িয়ে পোড়া ঘরের কাঠামোটুকু।
ভগবানগোলার সেই ছবি খবরের কাগজে দেখে শিউরে উঠেছিলেন অনেকেই। এক সন্ধ্যায় শেষ হয়ে যায় গোটা একটা গ্রাম। দমকল যতক্ষণে পৌঁছয়, প্রায় নিশ্চিহ্ন সুলতানপুর। ‘‘তবু এ সব নিয়ে মাথাব্যথা নেই প্রশাসনের। যখন আগুন লাগবে, দেখা যাবে, আগাম চিন্তাভাবনা নেই। এই তো অবস্থা!’’ —বাজারের মুখে দাঁড়িয়ে আলোচনা চলছিল জোরকদমে।
কারণ? মাথার উপর মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে বিদ্যুতের তার। আর তারই নীচে দিনরাত কড়াই আর খুন্তির ঠোকাঠুকির আওয়াজ। উনুনের গনগনে আঁচে চলছে রোল-চাউমিন রান্না। দু’হাতে বাজারের থলি নিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে তার উপর পড়ার দশা। কারণ দোকান তো ক্রমশ নেমে এসেছে পথে। আর পথ ক্রমশ সংকীর্ণ হতে হতে প্রায় উধাও। আতঙ্কে সাধারণ মানুষ।
ঘটনাস্থল কৃষ্ণনগরের পাত্রবাজার। বলা যায়, কৃষ্ণনগরের অন্যতম বড় ও ব্যস্ত বাজার। যদিও ‘অগ্নিনিরাপত্তা’ নামের বিষয়টি নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই প্রশাসনের কারও। ঘিঞ্জি বাজারে দিব্যি চলছে আগুন নিয়ে খেলা। শুধু তা-ই নয়, বাজার ঘেঁষেই রয়েছে পেট্রল পাম্প। পাশেই আবার হোটেল। রয়েছে মিষ্টির দোকানও। বড় কড়াইয়ে ঠুংঠাং রান্না চলে সেখানেও। এক ঝলকে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এ এক জতুগৃহ।
সব্জি বাজার ছাড়িয়ে মাছের বাজারেও একই অবস্থা। সেখানেও টিনের চালের নীচে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে বিদ্যুতের তার। এ ক্ষেত্রেও রাস্তাও সেই বেদখল। কোথাও অস্থায়ী ছাউনি তো কোথাও পাকাপাকি ভাবে দোকান। এক দিকে বিদ্যুতের তার ফাঁদ পেতে বসে তো অন্য দিকে, চায়ের দোকানের উনুন।
প্রতি দিন হাজার হাজার মানুষ আসেন এই বাজারে। এর মধ্যে রয়েছেন প্রশাসনের বড় কর্তারাও। থলি হাতে বাজার করতে আসেন স্থানীয় নেতারাও। কিন্তু কারও মাথায় আসে না কখনও, কখনও যদি আগুন লাগে, কী হবে? আগুনে পুড়ে মরতে হবে নাতো ওই জতুগৃহে? বাজারের অবস্থা দেখে দমকল বাহিনীর কিন্তু আশঙ্কা, তেমন কিছু হলে ভয়াবহ আকার নেবে আগুন। অল্পে রেহাই মিলবে না। কারণ দমকলের ইঞ্জিন ঢোকার মতোই তো জায়গা নেই। এ প্রশ্নে অস্বস্তিতে পড়লেও সম্মতি জানাচ্ছে পুরসভা।
এই পাত্রবাজারেই মাছের ব্যবসা করেন তারক হালদার। আগুনের কথা উঠতেই বললেন,‘‘আর বলবেন না, সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি। বাজারটা ক্রমশ ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে। মাথার উপরে যে ভাবে তারগুলো ঝুলছে, তাতে যে কোন মুহুর্তে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’’ কিন্তু কে শুনবে এ সব কথা? তারক বলেন, ‘‘মালিককে বললে গুরুত্বই দেন না। যে দিন কোন অঘটন ঘটে যাবে, সে দিন বুঝবে। তার আগে আমাদের কথা কেউ কান তুলবে না।’’
বিষয়টি নিয়ে উদ্বিঘ্ন ব্যবসায়ী সমিতিও। পাত্রবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক গোপাল বিশ্বাসের কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে বাজারের যা আবস্থা, তাতে আমরা সকলেই উদ্বিগ্ন। কিন্তু কাকে মানা করব, বলতে পারেন? সকলেই ব্যবসায়ী। তারা তো নিজেদের ভালটা বুঝবেন। তা ছাড়া এখন মূল বাজারের চারপাশের ব্যক্তি মালিকানায় অনেক দোকান হয়ে গিয়েছে। ফলে বাজারে এখন একাধিক মালিক। কেউ কাউকে মানে না। জানি না কোন দুর্ঘটনা ঘটলে, শেষ পর্যন্ত কী হবে।’’
কী বলছে দমকল?
তাদের বক্তব্য, একাধিকবার বাজার মালিক ও কমিটিকে সাবধান করা হয়েছে। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। দমকল বাহিনীর এক কর্তার কথায়, ‘‘এই মুহুর্তে আমাদের কাছে যা পাইপ আছে, তাতে আমরা প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে জল নিয়ে গিয়ে আগুন নেভাতে পারি। কিন্তু সেটাই তো সব কথা নয়। আমরা আসতে আসতেই তো যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যাবে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘সব চাইতে বড় কথা ওই সরু রাস্তা দিয়ে আমাদের গাড়ি ঢুকবে না। মাথার উপরে যে ভাবে বিদ্যুতের তার ঝুলে থাকে, সেটা তো আরও বিপজ্জনক। বিষয়টি নিয়ে এখনই সচেতন না হলে আগামী দিনে বিপদ আছে।’’
দমকল বাহিনীর কথায়, ‘‘আগুন যাতে না লাগতে পারে তার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করার পাশাপাশি আরও কয়েকটি বিষয় মেনে চলতে হবে। একাধিক অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডারের পাশাপাশি বাজারের ভিতরে বালি বোঝাই বালতি রাখা উচিত। আর সেই সঙ্গে আগুন নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা।’’
যদিও গোটা বাজার ঘুরে কোথাও বালির বালতি বা অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডারের দেখা মেলেনি। বাজারের মালিক লক্ষ্মণ ঘোষ বলেন, ‘‘কাকে কী বলব? দোকানদাররা তো কথাই শোনে না। তাঁরা একটু সচেতন হলে কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা না। বাজারটাকে ঢেলে সাজাতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন। সে চেষ্টাও করেছি। বিভিন্ন জায়গায় ‘লোনের’ জন্য ঘুরেছি। কিন্তু পাইনি।’’
লক্ষ্মণবাবুর বক্তব্য, ‘‘এই বাজার থেকে যা আয় হয়, তাতে আমার পক্ষে সব দিক সামলে ওই সব অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী মজুত রাখা কঠিন। বাজারের সামনেই পুরসভা মাটির নীচে দু’টি বড় বড় জলাধার করেছে। আশা করি তাতে সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।’’
কৃষ্ণনগর পুরসভার পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বলেন, ‘‘ওই বাজার ব্যক্তি মালিকানাধীন। তাই আমাদের কিছু করার থাকে না। আগে আমরা পুরসভার পক্ষ থেকে বাজারটা অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমান মালিক এত দাম চেয়েছেন যে, আমাদের পক্ষে আর বাজার কেনা সম্ভব হয়নি।’’ তিনি বলেন, ‘‘তবে শহরের মানুষের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে আমরা পাত্রবাজারের পাশেই মাটির নিচে দু’টি জলাধার বানিয়েছি। প্রতিটায় ১০ হাজার গ্যালন করে জল ধরে।’’
সব শুনে পাত্রবাজারে নিয়মিত বাজার করতে আসা শহরের এক প্রবীণ বাসিন্দা বললেন, ‘‘ভাবতে অবাক লাগছে যে সকলেই আগুন লাগার পরে কী করা প্রয়োজন, সেটা নিয়ে ভাবেন, কিন্তু কী করলে আগুন লাগা আটকানো যায়, তা নিয়ে কারও ভাবার সময় নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy