Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
বন দফতরের অবশ্য এ নিয়ে কোনও হেলদোল নেই, বলছেন ‘লোক কোথায়, পাঠাব কাকে’

কী করেন? নির্বিকার জবাব আসে: টিয়া-চুরি

পিচ রাস্তা বরাবর খানিক এগোলেই সার দিয়ে রেন-ট্রি। তার পর, অমলতাস-মোহনচূড়া-শিরিশ। ছায়ায় ছায়ায় অন্ধকার হয়ে আছে সেই মাঠ।

শিকার-পর্ব: গাছে উঠে কোটরে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনা হচ্ছে সদ্য ডিম ফোটা টিয়া-ছানা। তা রুখতেই পঞ্চায়েতের প্রয়াস। নিজস্ব চিত্র

শিকার-পর্ব: গাছে উঠে কোটরে হাত ঢুকিয়ে তুলে আনা হচ্ছে সদ্য ডিম ফোটা টিয়া-ছানা। তা রুখতেই পঞ্চায়েতের প্রয়াস। নিজস্ব চিত্র

কল্লোল প্রামাণিক ও গৌতম প্রামাণিক
করিমপুর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৭ ০১:১৭
Share: Save:

পিচ রাস্তা বরাবর খানিক এগোলেই সার দিয়ে রেন-ট্রি। তার পর, অমলতাস-মোহনচূড়া-শিরিশ। ছায়ায় ছায়ায় অন্ধকার হয়ে আছে সেই মাঠ।

শেষ শীতে শিকারপুর, নাটনার মাঠটা তাদের নিবিড় ঠাঁইনাড়া। বছর কয়েক আগে, লালগোলার নিরিবিলি সীমান্তের জামরুল-অর্জুনের বাগানটাও ছিল ওদেরই দখলে।

বাতাসে ফাগুন লাগলে, তাদের অনর্গল হল্লা আর থেকে থেকেই ব্যস্ত ডানায় উড়ে গিয়ে পোকা-পতঙ্গ ঠোঁটে ফিরে আসা।

টিয়ার সেই নিরাপদ রাজ্যপাটে পা পড়েছে চোরা কারবারিদের। তেমন ডাকসাইটে কেউ নয়। শিকারপুর-নাটনার আশপাশের গাঁ গঞ্জের হা-হদ্দ বেকার ছেলেপুলে, সামান্য টাকার হাতছানিতে এই চুরি-বিদ্যায় হাত পাকিয়েছে তারা। ভোরের দিকে তরতর করে উঠে যাচ্ছে গাছে। তার পর, কোটরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনছে সদ্য ফোটা ছানা। বরাত ভাল হলে মিলছে সপ্তাহ দুয়েকের পালক গজানোও।

প্রতি বছরই শেষ শীতে যখন ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে টিয়া-ছানারা রাতের কারবারটা শুরু হয় তখনই। দাম? সাত থেকে –দশ দিনের ছানা বিশ থেকে ত্রিশ টাকা। আর একটু বড় হলে চল্লিশ। বহরমপুর কিংবা কৃষ্ণনগর থেকে পাখ-পাখালির ব্যবসায়ীরা এসে সে ছানা কিনে নিয়ে গিয়ে বড় শহরের পাইকারদের হাতে তুলে দিচ্ছে ঢের বেশি দামে। কৃষ্ণনগরের মেলায় যা বিকোচ্ছে আড়াইশো থেকে পাঁচশো টাকায়। লালবাগের এক পাখি ব্যবসায়ী বলছেন, ‘‘গ্রামের বাসিন্দাদের সামান্য কিছু টাকা আগাম দিলেই রাত জেগে ওরা কাজটা করে দেয়। তবে পাখির যত্নআত্তি তো ওরা বোঝে না তাই চেপে ধরতে গিয়ে অনেক সময়েই ছানা মরে যায়।’’

বন দফতরের অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও হেলদোল নেই বলেই মনে করছেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। করিমপুরের একটি প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠনের শেখর মণ্ডল জানান, বহু বার অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁরা। তবে, নির্বিকার গলায় বনকর্মীরা জানিয়েছে, ‘লোক কোথায়, কাকে পাঠাবো!’। এ বার তাই নিজেরাই নেমেছেন টিয়া-পাচার রুখতে।

শেখর বলেন, ‘‘বছর কয়েক ধরে এটা শুরু হয়েছে। রাতে পাঁচ সেলের টর্চ নিয়ে গাছে উঠে ফোকড় থেকে বের করে আনছে ছানা। তার পর ডিমের ঝুড়িতে খড় বিছিয়ে রেখে দেয়।’’ ভোর হতে না হতেই পাচার হয়ে যায় ছানা।

এ বার তাই মরিয়া হয়ে টিয়াদের ঘরবসত দখল রুখতে নেমেছে ওই সংগঠনের কর্মীরা। শেখরের গলায় উষ্মা, ‘‘অথচ দেখুন, ব্যাপারটা জেনেও মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে বন দফতর।’’

বছর চারেক ধরে স্থানীয় গ্রামের কিছু যুবকের কাছে টিয়ার ছানা চুরির এই কারবার প্রায় ‘বাৎসরিক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদেরই একজন দরাজ গলায় বলছে, ‘‘জেলেরাও তো নদীর মাছ ধরে, আমরাও গাছের পাখি ধরছি, কারও পোষা তো নয়!’’ কিন্তু বন আইনে যে তা অপরাধযোগ্য এবং ধরা পড়লে হাজতবাস নিশ্চিত, জানেন? ধন্দে পড়ে যায় ওই গ্রামীণ যুবক।

সে বলে, ‘‘নিয়মকানুন তো জানি না। রুজির টানে টিয়া-চুরি করি।’’ পুরনো মেহগনি, পাকুর, কড়ুইয়ের শুকনো কোঠরে ঘর বাঁধা কণ্ঠী-টিয়া বা রোজ রিংগড প্যারাকিটের ছানা নিতান্ত স্বল্প দামে বেচে চলেছে ওরা।

শিকারপুরের পঞ্চায়েত প্রধান প্রসেঞ্জিৎ বিশ্বাস বলছেন, ‘‘ব্যবসাটা এ বারও শুরু হয়েছিল। তবে, এ বার আমরা প্রথম থেকেই সতর্ক আছি। ফেস্টুন ঝুলিয়ে দিয়েছি গ্রামে গ্রামে। মাইকেও প্রচার হচ্ছে।’’ সে প্রচারে সাড়া মিলছে কি না, সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Illegal Trade parrots
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE