Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ঘরে পুতুল রেখেই মাধ্যমিকে

একাগ্রতা আর মনোযোগের দৌড়ে পিছিয়ে থাকা ডাক্তারি পরিভাষায় ‘ইন্টালেকচুয়াল ডিসেবিলিটি’র ধাক্কা সামলে স্বস্তিকাকে নিয়ে তবুও বাবা-মা’র স্বপ্নের পরিমিতি নেই।

পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে ‘রাইটার’ পৌলমীর সঙ্গে স্বস্তিকা দাস। কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে ‘রাইটার’ পৌলমীর সঙ্গে স্বস্তিকা দাস। কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ঠোঁট কামড়ে জানলা মুখো উদাস উদাস মুখ করলেই ক্লাশ টেনের রাইটারের মাঝারি তিরস্কার ফিরে আসছিল, ‘‘দিদি এমন করলে ডাক্তার হবে কি করে বলো তো, বলোও কিছু আমাকে!’’ বার কয়েক এমন চাপা ধমকের পরেই কেঁদে ফেলল স্বস্তিকা, ‘‘বাড়ি যাব, আমার পুঁচকুকে দেখব...’’

পরীক্ষাটা এগোচ্ছিল ঠিকঠাকই, হারানো মন টেনে হিঁচড়ে উত্তর বলে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছিল স্বস্তিকা। তার কথাগুলো সাজিয়ে উত্তর লেখার চেষ্টা চালাচ্ছিল রাইটার পৌলমী ঘোষ। আচমকা কেঁদে একসা হয়ে এক ঘর পরীক্ষার্থীর সামনে নিজেই পুচকু হয়ে উঠল মেয়েটা। পুচকুকে বড় ভালবাসে স্বস্তিকা। আদরের পুতুলটা বাড়িতে রেখে এসেছে মনে পড়তেই বিপত্তিটা ভেঙে পড়ল হলঘরে। পৌলমী মৃদু ধমক দেয়, “দিদি মন দিয়ে পরীক্ষাটা দাও কিন্তু, ঠিক আছে আর কান্না নয়....তুমি না ডাক্তার হবে!’’ সে কথা কি আর স্বস্তি দেয় তাকে! কৃষ্ণনগরের মৃণালিনী গার্লস হাইস্কুলের বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধী স্বস্তিকা দাস, তখন মাধ্যমিক থেকে অনেক দূরে। তার পরীক্ষাকেন্দ্র কালীনগর গার্লস হাইস্কুল। বাবা সমীরণবাবুর সঙ্গে এসে হলে ঢোকার সময়ে এক বারও মনে হয়নি মেয়ে এমন করবে। সমীরণ বলছেন, ‘‘মেয়েটার প্রথম বড় পরীক্ষা। ডাক্তারেরা বলছেন খানিক বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে ওর তাই আয়োজনের ত্রুটি রাখিনি। তবু মেয়ের পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগটা যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না, বুঝলেন।’’

একাগ্রতা আর মনোযোগের দৌড়ে পিছিয়ে থাকা ডাক্তারি পরিভাষায় ‘ইন্টালেকচুয়াল ডিসেবিলিটি’র ধাক্কা সামলে স্বস্তিকাকে নিয়ে তবুও বাবা-মা’র স্বপ্নের পরিমিতি নেই। সমীরণ বলছেন, ‘‘থাক না একটু পিছিয়ে, দেখবেন পারবে, ঠিক পারবে ও! ওর পেরে ওঠার লড়াইয়ের ইচ্ছেটাকে তো সম্মান দিতে হবে আমাদের।’’ বাড়ির লোক জানাচ্ছেন, মেয়ে ছিল বড় চঞ্চল। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো না। শুধু টিভিতে বিজ্ঞাপনের সময় সে একেবারে চুপ। যেন হাঁ করে গিলে ফেলতে চায় টিভি। স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল তাকে। আর পাঁচটা শিশুর মতই। চঞ্চল মেয়েটি সে ভাবে মন বসাতে পারে না বইয়ে। ছুটে বেড়াতে চায়। পঞ্চম শ্রেণিতে অঙ্কে পাশ করতে পারল না সে। উঁচু ক্লাশে অন্য বিষয়েও পিছিয়ে পড়ছিল একটু একটু করে। কলকাতার ডাক্তার দেখিয়ে জানা গেল, মেয়ে তাঁদের অন্যরকম।

এত কিছুর মধ্যেও কিন্তু স্বস্তিকা নিজের মতো পড়তে বসে, স্কুলে যায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মনীষা রায় বলেন, ‘‘ও স্পেশাল এডুকেটরের সাহায্য পায়নি। সবটাই ওর কৃতিত্ব। এটাকেও তো সম্মান দিতে হবে।’’ সে সব সম্মানের কে ধার ধারে। স্বস্তিকা বলছে, ‘‘পুচকুকে পরে দেখব, নে এ বার লেখ....ভাল করে লিখিস কিন্তু!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE