Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Khap Panchayat

তালাক ভুলে ওঁরা কাছে আসতে চান, বাধা মুরুব্বিরা

যেখানে তাঁরা দল বেঁধে বসেন, সেখানেই শুরু হয় ‘বিচার’। ঝিমদুপুর কিংবা ডুমো বাল্‌বের নীচে গাঁ-গঞ্জের সেই মাতব্বরেরা ঠিক করে দেন কার স্ত্রী কার সঙ্গে থাকবে বা কার যৌবনের মেয়াদ কত, কার ইজ্জত থাকবে, কার যাবে। বেআইনি জেনেও তাঁদের ‘রায়’ মাথা পেতে নিতে হয়। নাহলে অপেক্ষা করে আরও বড় শাস্তি। সালিশির সুলুক-সন্ধানে আনন্দবাজারমাতব্বরেরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ওই মহিলার সঙ্গে অন্য কোনও পুরুষের বিয়ে দিতে হবে। কয়েক মাস নতুন দাম্পত্য জীবন কাটানোর পর দ্বিতীয় স্বামীর কাছ থেকে ওই মহিলাকে তালাক নিতে হবে। তবেই তিনি ফের নিকা করতে পারবেন আগের স্বামীকে।

অনল আবেদিন
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৮ ০১:৫৮
Share: Save:

সময়ের ব্যবধান নয় নয় করে তেইশটা বছর! জেলা এক হলেও জায়গা দু’টি আলাদা। মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার প্রায় উল্টো দিকে রঘুনাথগঞ্জ। কিন্তু দু’টো এলাকার ভৌগোলিক দূরত্ব মুছে দিয়েছে গাঁয়ের মাতব্বরেরা।

তিন তালাক ও নিকা হালালার মতো প্রথা তিলমাত্র পরিবর্তন আনতে পারেননি দুই এলাকার দুই দম্পতির জীবনে। এমনকী এক লহমায় তিন তালাক দেওয়ার প্রথা কোরান সম্মত নয় জানিয়ে ‘তালাক-ই-বিদ্দত’কে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বেআইনি ঘোষণাও সালিশি সভার মোড়লদের বিচলিত করতে পারেনি।

গ্রামের প্রান্তিক এক চাষি চান, সাত পুরুষের ভিটে বিক্রি করে দিয়ে অন্য একটি শান্ত এলাকায় বসবাস করতে। কিন্তু ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবন কাটানো ভিটের মায়া ছাড়তে নারাজ তাঁর স্ত্রী। তা নিয়ে দাম্পত্য কলহ। রাগের মাথায় ১৯৯৫ সালে অক্টোবর মাসের কোনও এক দিন বাড়ির কর্তা বলে ওঠেন, ‘‘তালাক! তালাক, তালাক!’’ গাঁয়ে সে কথা রটে যেতে সময় লাগেনি। হ্যাজাক জ্বালিয়ে, শীতলপাটি পেতে ওই দম্পতির বাড়ির উঠোনেই বসে সালিশি সভা। দু’জনেই মাতব্বরদের জানিয়ে দেন, রাগের মাথায় কথাটা বলে ফেলেছেন। তাঁরা দু’ জনের কেউই সত্যিই তালাক চান না। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

মাতব্বরেরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ওই মহিলার সঙ্গে অন্য কোনও পুরুষের বিয়ে দিতে হবে। কয়েক মাস নতুন দাম্পত্য জীবন কাটানোর পর দ্বিতীয় স্বামীর কাছ থেকে ওই মহিলাকে তালাক নিতে হবে। তবেই তিনি ফের নিকা করতে পারবেন আগের স্বামীকে। সে নিদান মানতে রাজি হননি ওই দম্পতি। মাতব্বরেরা তখন নিদান দেন, ‘‘ওই পরিবারকে একঘরে করা হল। মুদির দোকান, কলের পানি, গোচারণ ভূমিতে গবাদি পশুর প্রবেশ নিষিদ্ধ হল। ধোপা-নাপিত- সহ সব কিছু বন্ধ করা হল।’’

কথাটি কানে গেল সিপিআই- এর বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক উম্মলওয়ারা বেগম ওরফে ফুলদির কানে। ফুলদি (বর্তমানে প্রয়াত) আবার মহিলা মৌলবিও বটে। তিনি তালাকপ্রাপ্ত শতাধিক মহিলাদের নিয়ে মিছিল করে হরিহরপাড়ার বিডিও-র কাছে পৌঁছন। অবশেষে প্রশাসনিক প্রচেষ্টায় মাঝবয়সী ওই দম্পতির একঘরে প্রথা শিথিল করতে বাধ্য হয় মাতব্বরেরা। তবে সেই সময়টা যে কত কঠিন ছিল, কী নির্মম লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে তা আজও স্পষ্ট মনে আছে গ্রামের লোকেদের। তাঁদের কথায়, ‘‘সে এক সময় গিয়েছে! ওই দু’জনে চাইছেন একসঙ্গে থাকতে। কিন্তু গ্রামের মাতব্বরেরা একবগ্গা!’’

এত বছর পরেও কি সেই নিয়মটা বদলেছে? রঘুনাথগঞ্জের এক মহিলা বলছেন, ‘‘মাতব্বরদের সৌজন্যে আমার জীবনটাই এলোমেলো হতে চলেছে গো, বদলাবে কি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Khap Panchayat Law
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE