Advertisement
E-Paper

লালচেলি পরে আসতেন আড়ি লক্ষ্মী

মির্জাপুর গ্রামে আশ্বিনের সন্ধ্যা নামত একটু অন্য ভাবে। অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অখ্যাত ছোট্ট গ্রাম মির্জাপুর। সকালেই গ্রামের সকলের ‘যোগ দিদা’ ফরমান জারি করে দিতেন— ‘আজ দুপুরে পাক হবে।’

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৪১

মির্জাপুর গ্রামে আশ্বিনের সন্ধ্যা নামত একটু অন্য ভাবে। অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অখ্যাত ছোট্ট গ্রাম মির্জাপুর। সকালেই গ্রামের সকলের ‘যোগ দিদা’ ফরমান জারি করে দিতেন— ‘আজ দুপুরে পাক হবে।’ স্নানের ঘাট থেকে মুখে মুখে সে খবর ছড়িয়ে পড়ত গ্রামের প্রতিটি বাড়ির অন্দরমহলে। সে দিন দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাঠ তাড়াতাড়ি চুকিয়ে, হেঁসেল গুছিয়ে, দু-দণ্ড জিরিয়ে নিয়েই পাড়ার বৌরা সবাই হাজির হতেন ‘যোগ দিদা’ ওরফে যোগমায়া দেবীর উঠোনে। সেখানেই ঠিক হত,আজ কার বাড়ির ‘পাক’ হবে।

পাক শুরু হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আশ্বিনের হিম হিম সন্ধ্যায় জ্বলে উঠত কুপি। চারিদিক অন্ধকারে ঘেরা সেই উঠোনে স্বল্প আলোয় গোল হয়ে বসে জনা আটেক মধ্যবয়সি মহিলা ক্ষীর, নারকেল, চিনি, দুধ, চিঁড়ে, খি, তিলের মতো সাধারণ উপকরণ দিয়ে তৈরি করে চলেছেন নানা অসাধারণ সুখাদ্য। সুগন্ধে ম ম করতো চারপাশ। আর ঠিক মাঝখানে জলচৌকির উপর মধ্যমণি হয়ে বসে সবকিছু তদারক করছেন যোগদিদা। পাক সারা হতে হতে শিয়াল ডেকে উঠে জানান দিত রাতের প্রথম প্রহর শেষ।

স্মৃতি থেকে শ্বশুরবাড়ির কোজাগরীর কথা প্রভাবতী দেবী। প্রায় ষাট বছর হল যশোর ছেড়ে এসেছেন নদিয়ায়। কোজাগরী লক্ষীপুজোর দিন কেবলই মনে পড়ে সে সব কথা। বলেন, “সেই কবে ওদেশ ছেড়েছি। আর কিছুই তো আনতে পারিনি স্মৃতিটুকু ছাড়া। এখানেও এখন কোজাগরীতে খুব ধুম। খাওয়াদাওয়া, আলো, বাজি পোড়ানো। কিন্তু ভেটের নাড়ু, ফালার নাড়ু, তক্তি বা নারকেলের সাঁজ কিংবা গঙ্গাজলীর নামই জানে না কেউ। ও সব ছাড়া কোজাগরী হয় নাকি?”

জানালেন, পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পূর্ববঙ্গের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এক জন করে যোগ দিদা থাকতেন। যাঁদের হাতের ছোঁয়ায় স্বাদ বদলে যেত কোজাগরী, পৌষপার্বণ কিংবা নবান্নের। নিজের ছোটবেলায় মামাবাড়ির কোজাগরীর প্রস্তুতির কথা বলতে গিয়ে ষাট বছর পিছিয়ে গিয়েছিলেন ননীবালা দেবী। যোগমায়া ওরফে যোগদিদা ছিলেন সত্তর পার করা ননীবালার দিদিমা। প্রবীণা নাতনির কথায়, ‘‘দিদিমা যে কত রকমের খাবার বানাতে জানতেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। মায়ের মুখে শুনেছি, যে কোনও উৎসবে গোটা গ্রাম মুখিয়ে থাকত যোগমায়ার হাতের ম্যাজিক দেখার জন্য। বয়স হয়ে যাওয়ার পর দিদিমা ষষ্ঠী থেকে পাড়ার বৌদের নিজের হাতে শেখাতেন ওই সব সুখাদ্য তৈরির কায়দা।’’

যোগদিদার রান্নাঘরের সামনে ছিল একফালি উঠোন। তাঁর ছিল এক অদ্ভুত নিয়ম। এক-এক দিন এক-এক বাড়ির জন্য পাক হবে। ননীবালা দেবীর কথায় “আমাদের ছোটবেলায় পূর্ববঙ্গের গ্রামদেশে দুর্গাপুজো নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। বরং কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোই ছিল সব থেকে বড় উৎসব। প্রায় বিয়ে বাড়ির মতো ধুমধাম হতো। আসলে পূর্ববঙ্গে বছরে ওই একবার লক্ষ্মীপুজো হত।”

আবার কোজাগরী পূর্ণিমা কখন লাগছে তা নিয়ে ভারী সতর্ক থাকতেন যশোরের সরকার বাড়ির প্রধানকর্ত্রী হেমবরণী। পাছে ‘সঠিক সময়’ হাতছাড়া হয়ে যায়। আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশী ছেড়ে যে দিন পূর্ণিমা লাগবে, সে দিন কুলপুরোহিতকে কাছ ছাড়া করতেন না তিনি। চতুর্দশী যত ফুরিয়ে আসত ততই ব্যস্ততা বাড়ত তাঁর। পুরোহিতকে তাড়া দিতেন, “ঠাকুরমশাই, সময় হল?” বাড়ির অন্যান্য বৌ-মেয়েরা শাঁখ নিয়ে তৈরি থাকতেন। পঞ্জিকা হাতে নিয়ে বালিঘড়িতে সময় দেখে পুরোহিত মশাই সঙ্কেত দিতেই এক সঙ্গে বেজে উঠত অনেক শাঁখ। নিকানো উঠানে পাতা একখানি নতুন কাপড়ের ওপর হেমবরণী একটি বিরাট আকারের লক্ষ্মীর ঘট এনে রাখতেন। ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে সারা বছর রাখা থাকত ওই ঘট। বাড়ির মহিলারা বছরভর ওই ঘটে পয়সা জমাতেন। কোজাগরী পূর্ণিমা পড়তেই সেই ঘট ভেঙে যে পয়সা পাওয়া যেত, তা দিয়ে কেনা হতো লক্ষ্মীপুজোর একটি উপকরণ এবং আর একটি মাটির ঘট।

প্রভাবতী দেবী বলেন, ‘‘এখনও মনে আছে গঙ্গাজলীর রেসিপি। প্রথমে নারকেল কুড়ে ভাল করে ঘিয়ে ভেজে নেওয়া হত। সেই ভাজা নারকেল শিলনোড়ায় বেঁটে মিহি পাউডারের মতো করে নেওয়া হত। চিনির ঘন রসের সঙ্গে ওই বাঁটা নারকেল, ক্ষীর, এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে মণ্ড প্রস্তুত করা হত। সব শেষে নানা আকারের পাথরের ছাঁচে ফেলে তৈরি করা হত গঙ্গাজলী। অমৃতস্বাদের সেই মিষ্টি খাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।’’

কোজাগরীতে লক্ষ্মীর রকমফেরও ছিল দেখার মতো। কোথাও দুর্গাঠাকুরের মতো বড় প্রতিমা। কোথাও কলাবউ গড়ে পুজো তো কোথাও আবার সরালক্ষ্মী। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এ সব লক্ষীসরায় বেশির ভাগ সময়ে আঁকা থাকত রাধাকৃষ্ণ অথবা দুর্গার ছবি। দাঁড় করানো বড়সড় কলাগাছের গায়ে নতুন শাড়ি জড়িয়ে তৈরি কলাবউ। তার গোড়ায় লক্ষ্মীসরা আর সবার সামনে ঘট। এ ভাবেই পুজোর আয়োজন হতো। সবটাই করতেন বাড়ির মেয়েরা। কলাবউ, ঘট, লক্ষ্মীসরা ছাড়াও ও-পার বাংলায় আরও এক রকম ভাবে কোজাগরী পুজো হতো। বেতের ছোট চুপড়ি বা ঝুড়িতে ধান ভর্তি করে তার ওপর দু’টি কাঠের লম্বা সিঁদুর কৌটো লালচেলি দিয়ে মুড়ে দেবীর রূপ দেওয়া হত। নাম ছিল ‘আড়ি লক্ষ্মী’। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রভাবতীদেবী বিড়বিড় করতে থাকেন— ‘‘এখানে সে ভাবে পুজো হয় কোথায়?’’

Laxmi Puja Nabadwip
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy