Advertisement
E-Paper

চিনব না কী গো, এতো গোলাম চোর

পাঁচিল বরাবর লম্বাটে রাস্তা। নুনছাল ওঠা জামার হাতায় মুখটা এক বার সাপটে মুছে নিয়ে কোলাপসিবল ফাঁক করে টুক করে সেঁদিয়ে গিয়েছিল লোকটা। ঘরের হুড়কোটা বাইরে থেকে তুলে দিয়ে, একটা হাসিও কি খেলে গিয়েছিল তার মুখে!

সুজাউদ্দিন

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৬ ০৬:০৩

পাঁচিল বরাবর লম্বাটে রাস্তা। নুনছাল ওঠা জামার হাতায় মুখটা এক বার সাপটে মুছে নিয়ে কোলাপসিবল ফাঁক করে টুক করে সেঁদিয়ে গিয়েছিল লোকটা।

ঘরের হুড়কোটা বাইরে থেকে তুলে দিয়ে, একটা হাসিও কি খেলে গিয়েছিল তার মুখে! লুঙির কোঁচড় থেকে তালা-খোলার ছোট্ট যন্ত্রটা বের করে সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই খুলে ফেলেছিল দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলের লকটা।

তার পর, প্যাডেলে চাপ দিয়ে নিমেষে হু হু করে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল লোকটা।

মাস্টারমশাই সবটাই দেখেছেন, তবে, ঘরে ফিরে, চুরিটা হয়ে যাওয়ার ঘণ্টা দেড়েক পরে।

খান কয়েক সুপুরি, দু’টো বড়সড় আম আর কুঁড়ি ওঠা বেল-জবায় সাজানো নিরিবিলি বাড়ি। বড় যত্ন করে সাজিয়েছেন ভাতশালা স্কুলের প্রধানশিক্ষক মতিউর রহমান বিশ্বাস। স্ত্রীও স্থানীয় স্কুলের শিক্ষিকা। শিক্ষক দম্পতি স্কুলে বেরিয়ে গেলে বড় খাঁখাঁ করে বাড়িটা।

কাজের লোক একটা আছে বটে, তবে, মতিউর বলেন, ‘‘ছোঃ, তার কথা ছাড়ুন।’’ পড়শিরা আঁচল চাপা দিয়ে জানাচ্ছেন, আসলে মতিউর মাস্টারের সক্কলকে বড় সন্দেহ। সাধের বাড়িটা তাই খান চারেক সিসিটিভি-তে বেঁধে রেখেছিলেন মতিউর মাস্টার।

নিজের শোওয়ার ঘর থেকে বারান্দা, হেঁশেল ছুঁয়ে খিড়কি দুয়ার—কুটোটি নাড়ার জো নেই, সব তাঁর চোখ-দর্পণে! মন ভরেনি তাতেও। দিন কয়েক আগে, মনটা খুঁত খুঁত করায়, বাইরে দোর গোড়ায় আরও একটা সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে বিড়বিড় করেছিলেন— ‘‘সাবধানের মার নেই বাবা!’’

মাস্টারের বাঁ হাতটা নেই। সেই কোন ছেলেবেলায় রাইস মিলে হাতটা কাটা গিয়েছিল। চাপা স্বরে পরিবারের লোকজন বলেন, ‘‘সেই থেকে বড় খুঁতখুঁতে হয়ে পড়েছেন তিনি।’’

তা, সেই সাবধানি মানুষটার নজরদারির উপরেই বাটপারি করে তাঁর সাধের সাইকেলখানা নিয়েই হাওয়া হয়ে গেল ‘গোলাম চোর’।

আর আপনি চোরের কীর্তিকলাপ হাঁ করে দেখলেন? দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁটার ফাঁকে মতিউর বলেছিলেন, ‘‘তা কেন, সিসিটিভিতে সব ধরা দিয়েছে গো! ক’টা দিন সবুর কর, সাইকেল ঠিক ফিরে আসবে।’’

মতিউর মাস্টারকে কেউ শাসিয়ে যায়নি—‘মাস্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’। বরং পড়শির কৌতূহল মিটিয়ে মাস্টার বলেছেন ‘‘আমি সব দেখেছি। দেখুন না কী করি! তবে কী, চোরটার স্পর্ধা দেখে অবাক লাগছে, হতভাগা দেখল না বাড়িতে ছ-ছখানা...।’’

পুলিশের পথ মাড়াননি তিনি। তবে হাল ছাড়েননি। নিজের দামী মোবাইলে সিসিটিভির ফুটেজটা ডাউনলোড করে নিজেই পথে নেমেছিলেন চোর ধরতে।

দিন কয়েক ধরে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, পড়শি গ্রামে পাড়ি দিয়ে— দিনভর দেখিয়ে বেরিয়েছেন সেই তমিনিট দেড়েকের ফুটেজ— ‘‘হ্যাঁ গো লোকটাকে চেনা লাগছে?’’ কেউ বলেছেন, না তো চিনি না। কেউ বা ‘চেনা চেনা লাগলেও ঠিক ঠাওর’ করতে পারেননি।

তবে বেশি দিন সবুর করতে হয়নি। দিন তিনেক পরে, পড়শি গ্রামের এক যুবক ছবিটা দেখেই চোখ ছানাবড়া করে জানিয়েছিল— ‘‘চিনব না কী গো মাস্টার, এ তো গোলাম চোর গো! আমাদের বাড়িতে ঢুকে ধরা পড়েছিল গেল বার!’’ আর দেরি নয়। ঠিকানা পত্তর নিয়ে পরের দিন সাতসকালেই ডোমকলের কালীতলাপাড়ায় হাজির হয়েছিল মতিউর মাস্টার। সটান গোলামের বাড়ি।

তখনও বিছানা ছাড়েনি গোলাম শেখ (নাম পরিবর্তিত)। মোবাইলটা চালু করে, কোনও গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই মাস্টার বলেন, ‘‘কই রে গোলাম, ভিডিওটা পুলিশের কাছে নিয়ে যাব না সাইকেলটা মানে মানে দিয়ে দিবি!’’ ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। গোলামের বাড়িতে মাস্টারকে দেখে উঠোনে ভিড় জমতে শুরু করেছে। সকলেই হামলে পড়েছে মাস্টারের স্মার্টফোনের স্ক্রিনে— কী দাপট গো মাস্টারের, গোলামের চুরিও ধরে ফেলল!

চোখ কচলে স্মার্টফোনে নিজের বাহাদুরির বহর দেখে ততক্ষণে আমতা আমতা শুরু করেছে গোলাম। মানে মানে বন্ধুর বাড়িতে রেখে আসা মতিউর মাস্টারের সাইকেলটা নিয়ে আসে সে। তার পর মাস্টারের পায়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে— ‘‘ভুল হয়ে গেছে স্যার! আর কক্ষনো হবে না।’’

মাস্টার অবশ্য কথা বাড়াননি সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে মুচকি হেসে বলেছেন, ‘‘ওটা মতিউর মাস্টারের বাড়ি’রে গোলাম, আর কক্ষনো পা বাড়াস না। বাড়িতে কী পুষেছি জানিস, ছ-ছ’খানা....।’’

আর, মতিউর মাস্টার ফিরে যেতেই, ম্রিয়মান গলায় গোলাম বলেছে, ‘‘ঘরে ঘরে এমন যন্তর বসালে মাইরি না খেয়ে মরতে হবে তো!’’

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

School teacher Bicycle theif CCTV camera
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy