অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।
রাত থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি। কখনও মুষলধারে, কখনও ইলশেগুঁড়ি। সাতসকালে চারদিক জল থইথই। অফিস-কাছারি শিকেয়। বাড়ির কর্তা দু’কাপ চা শেষ করে ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ ভঙ্গিতে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন। গলাটা একটু ঝেড়ে বললেন “হ্যাঁ গো শুনছো, আজ একটু খিচুড়ি হোক। দেখি এক বার বাজারে গিয়ে...।’’
সাহস করে মুখে কিছু বললেন না বটে তবে গোপন একটা ইলিশ-ইচ্ছে নিয়ে থলি হাতে বেরিয়ে গেলেন বাজারে। যেতে যেতে মনে পড়ল ছেলেবেলায় সুর করে কাটা সেই ছড়াটা— ‘সর্ষে বাটা জোরসে দাদা/ঠেঙিয়ে বাজার ডিঙিয়ে কাদা/ চারটে ইলিশ মাছ কিনেছি/ বাদলা এমন এই দিনে... ছি।’
তবে হাজার দেড়-হাজার টাকা দামের ইলিশ সকলের সাধ্যে না কুলোলে গরমাগরম খিচুরির সঙ্গে ডিমের ওমলেট বা মুচমুচে পাঁপড় বা বেগুনিও নেহাত খারাপ নয়। শেষ পাতে একটু চাটনি হলে সোনায় সোহাগা। বৃষ্টির দিনে বাঙালি হেঁশেলের ‘সিগনেচার টিউনই’ হল খিচুড়ি। একটা সময় বর্ষায় খিচুড়ি-ইলিশ ছাড়া ভাবাই যেত না। কত গল্প সেই খিচুড়িকে ঘিরে। সময়টা ষাটের দশক। সে দিনও নাছোড় বৃষ্টিতে নাজেহাল কৃষ্ণনগর। জেলা সদরে সে কালের নামকরা হোটেল, ‘বাসশ্রী’তে তুমুল ব্যস্ততা। এমন দুর্যোগের সকালে দোতলার কোনের ঘরের ‘বোর্ডার বাবু’ নাকি হোটেল মালিকের কাছে খিচুড়ি আর ইলিশভাজা খেতে চেয়েছেন। তিনি মাঝেমধ্যেই হোটেলে আসেন এবং কোনের ঘরেই বেশ কয়েক দিন থাকেন। এ দিকে মালিক হরেন্দ্র সাহার কড়া হুকুম—‘হোটেলে এলে বাবুর যেন অযত্ন না হয়।’ কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে মালিকের হুকুম অমান্য করে। অতএব খিচুড়ি ইলিশের প্রস্তুতিতে সাজ সাজ রব হোটেল জুড়ে। সেই বাবু আর কেউ নন, মণীশ ঘটক।
শুধু গেরস্তের হেঁশেলে বা হোটেল বলে নয় বর্ষার দিনে খিচুড়ি নবদ্বীপের মঠ-মন্দিরের ভোগের ঘরও আলো করে রাখে। নবদ্বীপের ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী জানান, আকাশের সঙ্গে দেবতার ভোগের সম্পর্ক নিবিড়। তাই বর্ষার সকালে তেমন বৃষ্টি হলেই মহাপ্রভুর জন্য খিচুড়ি ভোগের আয়োজন করতে হয়। সঙ্গে বেগুনি, পাঁপড় ভাজা। তবে ঠাকুরবাড়িতে খিচুড়ি নাম ‘কিশোরী অন্ন’। আর রসিক বাবাজিরা আদর করে ডাকেন ‘হলদে প্রভু’ বলে।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিখ্যাত শিল্পী অরুণ ভাদুড়ির সঙ্গীত জীবনের প্রথম পর্বের প্রায় পুরোটাই কেটেছে বহরমপুরে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে খাগড়া এলাকায় ২৯ নম্বর রামসুন্দর মুন্সি লেনের একতলার তিন কোনা একটি ঘরে। ওস্তাদ আবু দাউদ তাঁর সেই নিজস্ব ঘরে বসেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম দিতেন অরুণ ভাদুড়ি-সহ অনেককেই। কণ্ঠের যত্নের জন্য খাদ্যের বিষয়ে আবু দাউদের বিশেষ কিছু বিধিনিষেধ ছিল। বিশেষ করে তেলেভাজা তাঁর কাছে ছিল নিষিদ্ধ! কিন্তু ছেলের একেবারে উল্টো ছিলেন বাবা কাদেরবক্স মণ্ডল। কাদের সাহেব তখন মৃত্যুশয্যায়। এ দিকে পেটের ব্যামো ভুলে বর্ষার বিকেলে তিনি আবদার করে বসলেন প্রিয় তেলেভাজা!
এমন তৈলাক্ত প্রেমের আরও নজির রয়েছে। ভরসন্ধ্যায় ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। করিমপুরের গৌতম বিশ্বাস গিন্নির নিষেধ উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়লেন বাজারে। বাসস্ট্যান্ডের সেই চপ বিক্রেতাও যেন তাঁর অপেক্ষায় ছিলেন। দেখেন বললেন, ‘‘এই যে কত্তা, এক্কেবারে কাকাভেজা হয়ে গিয়েছেন যে। দাঁড়ান, এখনই খানকয়েক আলুর চপ আর বেগুনি ভেজে দিচ্ছি।’’ গৌতম মনে করেন, ‘‘বৃষ্টির সন্ধ্যায় যিনি তেলেভাজা আর মুড়ি খান না, তিনি ঠান্ডা মাথায় খুনও করতে পারেন।’’
কয়েক যুগ আগের কথা। এমনই বর্ষাকাল। আবু দাউদের বাড়িতে এসেছেন সারেঙ্গি আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওস্তাদ সাগরুদ্দিন খাঁ। আবু দাউদের স্ত্রী দিলরুবা বেগম রান্না করলেন কামিনীভোগ চালের ভুনা খিচুড়ি, পাঁপড় ভাজা সঙ্গে কষা মাংস। খাওয়ার পর ঢেকুর তুলে সে দিন সাগিরুদ্দিন খাঁ বলেছিলেন, ‘‘আহা, কী খেলাম। আমিনার বিরিয়ানিও এই স্বাদের কাছে তুচ্ছ!’’
বর্ষার দিব্যি, বেঁচে থাক এমন জিভে প্রেম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy