Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হারানো জ্যোৎস্নায় ক্ষত খোঁজে সে

মেয়েটা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এত নিঃসাড়ে আসে....বড় বোঝে তাকে। পরিমল একটা ঘন শ্বাস ছেড়ে বলে, ‘না মা, কিস্যু না, হেই দ্যাখ কেমন নিশ্চুপে পুজা আইসা গেল...।’

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:৫১
Share: Save:

বড় নদী থেকে চুপচাপ একলা হয়ে যাওয়া পিছারার খাল। পরিবারের অবিবাহিত মেয়েটির মতো একা, নিঝুম, সান্ধ্য বিনুনির মতো তির তির করে বইছে।

পরিমল রেডিওটা চালিয়েই টের পায় ব্যাটারি নেই। ক’দিন নাগাড়ে ঝিরঝির টিপটিপের পরে, আজ ধরেছে। রোদ লুটোচ্ছে রাস্তায়, ভাদ্র।

বিছানার উপরে উথালপাতাল খবরে কাগজে বিজ্ঞাপনটা ফড়ফড় করে তার সামনে নিজেকে বিছিয়ে দেয় আবার...আর তেরো দিন।

বাবা কী দেখছ?

মেয়েটা পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। এত নিঃসাড়ে আসে....বড় বোঝে তাকে। পরিমল একটা ঘন শ্বাস ছেড়ে বলে, ‘না মা, কিস্যু না, হেই দ্যাখ কেমন নিশ্চুপে পুজা আইসা গেল...।’

শিউলিবোনা ছেড়ে আসার সাতচল্লিশ বছর পরেও পরিমলের পাঁজরের ঘাগুলো এখনও শুকোয়নি। গোবর, কচুরিপানা, হাঁসের পালক— গন্ধগুলো এখনও হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে বইকি, আর কেউ না বুঝুক, মা-মরা মেয়েটা ঠিক আঁচ পায়।

চা খাবে একটু, বাবা?

—আমার একার জইন্য দরকার নাই, তুই খাইলে অবশ্য... জানস কাইল রাতে চক্কোত্তিদের মণ্ডপে ঢাকের আওয়াজ শুইনলাম, স্পষ্ট।

মিনি টের পায়, পাড় ভাঙছে বাবার। চোরা পলির টানে ফের কাঁটাতার ছিঁড়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে পরিমল... ছিমছাম সেই পিছারার জলধারা সাঁতরে শিউলিবোনার চক্রবর্তীদের মণ্ডপখানার মেঝে-ফাটা চাতালে পৌঁছে গিয়েছে বাবা। সম্বৎসর ঝোড়ো তাল আর ভাঙা বাসার মতো ঘেঁটু ঝোপের আড়ালে পড়ে থাকা যে মণ্ডপে এলা রং পড়তে শুরু করেছে আবার। দল বেঁধে তারা হাঁ-মুখ বিস্ময়ে দেখছে, সেই পোড়ো মণ্ডপ রোদ্দুরের মতো হলুদ হয়ে উঠছে।

—‘হেই পরি, খাইলে নাও ভিড়সে রে....’ সুপুরি সারির ফাঁক গলে, অস্ফূট কাঁপা কাঁপা শিসের মতো ডাক আসছে তার কাছে, কে ডাহে? মনা, শিবনাথ, নাহি গফ্ফর, দুপুরে এক ফালি রোদে বাঁশপাতা আর খেজুরের কাঁটা বেঁধা পায়ে সে হাতড়ে বেড়ায় শিউলিবোনার জলজ সুঘ্রাণ।

গত কয়েক বছর ধরে পুরনো ভিটের কাদা মাখা উঠোনে একটি বার পা রাখতে চায় পরিমল। মিনি জানে, কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসার কথা উঠতেই পরিমল দাবড়ানি দেয়, ‘কও কী, নিজের ভিটায় পা দিমু পাসপোর্ট লইয়া...হেইডা আবার অয় নাহি।’ অনেক দূর এগিয়েও মিনিকে তাই পিছু হটতে হয়েছিল, পরিমল স্পষ্ট করে দিয়েছিল, ‘যামু না।’

দেশভাগের সেই ঘা’টা পুজোর সময়ে বড় দগদগে হয়ে উঠছে আবার! ছেলেবেলায় ধবল গাইয়ের গুঁতোয় ফাটা হাঁটুর পুরনো দাগটায় হাত বোলায় সে, ‘হেইড্যা এহনও আছে...’ আর কী আছে?

মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, একা একা জানলার ধারে এসে দাঁড়ায়, তার পর রাস্তার আলোয় হারানো জ্যোৎস্না চেনার চেষ্টা করে সে। কান পাতলেই শুনতে পায়, ঢাক বাজছে চক্রবর্তীদের মণ্ডপে, সারা শরীরে হাত বুলিয়ে সে খোঁজে...‘আর কুন দাগ নাই শরীরে, দ্যাশটারে একটু ছুঁইয়া দ্যাখতাম যে...আর সেই দাগখান কুথায় গেল,...’বাঁ হাতের কব্জির কাছটা হাতড়াতে থাকে পরিমল, পাগলের মতো, পঞ্চমীর সকালে, হাঁ মুখ সিংহের কোটরে হাত গলিয়ে সেই রক্তারক্তি কব্জি! সেই দাগ গেল কোথায়? রাতের অন্ধকারে হাতড়াতে থাকে পরিমল, কোথায় গেল সেই দাগ? সে স্পষ্ট শুনতে পায়, মণ্ডপের উঠোন থেকে গফ্ফর বলছে, ‘অ মা, পরি, তোর আতে অমন রক্ত কেমনে আইল রে...অ পরি ক!’ মনা ডাকছে, চল পরি হাতখান ধুইয়া আয় না অইলে...হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে পরিমলের বুক, সেই দাগটা হারিয়েই গেল? দাঁড়া দেখাইত্যেসি... পরিমল পাগলের মতো এ দিক ও দিক তাকায়, তার পর, পরিপাটি টেবিল ক্লথের নীচ থেকে বের করে আনে সকালেই কেনা দাড়ি কামানোর ব্লেডটা। সেই জ্যোৎস্না খোঁজা রাতে আঁকাবাঁকা হাতে তা চালাতে থাকে কব্জির উপরে...খানিক যন্ত্রণা, পরিমল হাঁফাচ্ছে, তার পর... পিছারার খালের মতো তির তির করে রক্তস্রোত ভাসিয়ে দেয় রংচটা বিছানার চাদর...

বড় ঘুম আসে, পরিমল টের পায়, নাও ছাইড়্যা দিল... সে ভেসে যাচ্ছে শিউলিবোনা গ্রামে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2017 Memory
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE