Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

মোবাইল নিলি কেন? মনোরোগীকে পিটিয়ে খুন

পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল মোবাইল। আর সেটা কুড়িয়ে পেয়েছিল মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক। তাকে চোর ঠাওরে অতঃপর শুরু হয়েছিল পড়শি গ্রামের এক বীরপুঙ্গবের প্রহার।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অমলা। ইনসেটে, মনোজ।

কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অমলা। ইনসেটে, মনোজ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৬ ০২:২৪
Share: Save:

পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল মোবাইল। আর সেটা কুড়িয়ে পেয়েছিল মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবক। তাকে চোর ঠাওরে অতঃপর শুরু হয়েছিল পড়শি গ্রামের এক বীরপুঙ্গবের প্রহার। আহত মনোজ তালুকদার (৩০) নামে ছেলেটি মারা গিয়েছিল তার জেরেই।

তবে দোষ এড়াতে তার নিথর দেহটা পাট খেতে ছুড়ে ফেলে হাত ধুয়ে ফেলেছিল শিবম পোদ্দার নামে ওই যুবক ও তার সঙ্গীসাথীরা।

দিন সাতেক পরে শনিবার সেই রহস্যের কুয়াশা ভেদ করল পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছে শিবম ও তার সঙ্গীকে।

পুলিশের জেরায় শিবম কবুল করেছে, মনোজ-হত্যার আস্ত ঘটনাটি।

পকেট হাতড়ে বিড়ি না পেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির কাছে একটি বিড়ি চেয়েছিল যুবক। কিন্তু তার কাছে বিড়ি কোথায়!

খেপাটে ছেলেটির গালে চড় কষিয়ে ফিরে গিয়েছিল বীরপুঙ্গব। কিন্তু বাড়ি গিয়েই বুঝতে পারে পকেটে নেই মোবাইল। গেল কোথায়?

সন্দেহ ঘুরে যায় গ্রামের সেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেটির দিকে। ফের রাস্তায় নামতেই ওই যুবক দেখে তার হারানো মোবাইল হাতেই এলোমেলো ঘুরছে ছেলেটি। বীরত্ব দেখিয়ে এ বার শুরু হয় শাসন— কিল, চড়, লাথি, ঘুষি। রোগাটে ছেলেটি সে ধকল নিতে পারেনি। ধপ করে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। তা দেখে আশপাশের লোকেরা চেপে ধরে ওই যুবককে, ‘মারলে যখন তখন এ বার হাসপাতালে নিয়ে যাও’। সঙ্গীসাথী জুটিয়ে জখম ছেলেটিকে ভ্যানরিকশায় চাপিয়ে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই নিঃসাড় হয়ে পড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেটি।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। চারপাশে তাকিয়ে ওই যুবক এ বার স্পন্দনহীন দেহটা ফেলে দেয় পাশের পাট খেতে। দায় শেষ। এ বার নিশ্চুপে সরে পড়ে সে। বর্ষায় বেড়ে ওঠা পাট খেতের আড়ালেই প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকে মনোজ তালুকদারের (৩০) দেহ।

বাড়িতে তাঁর স্বজন বলতে মা অমলাদেবী। তিনি পরিচারিকার কাজ করেন। পুলিশকে তিনি জানান, অন্য দিনের মতো ১৭ জুলাই মনোজ খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি থেকে বের হয়। রাতে আর ফেরেনি। তবে বেশি রাতে পাড়ার এক যুবকের কাছে অমলা জানতে পারেন, ছেলেকে মারধর করা হয়েছে। সে বগুলা গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেই রাতেই অমলা হাসপাতালে ছোটেন। কিন্তু ছেলে কোথায়?

পরের দিন সকালে আবারও প্রতিবেশী এক যুবককে নিয়ে হাসপাতালে যান। সকালেও তার কোনও সন্ধান না পেয়ে তিনি যান বগুলা পূর্বপাড়া। সেখানে খোঁজখবর করে জানতে পারেন যে আগের দিন সন্ধ্যায় মনোজকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয় গ্রামবাসীরা তাকে এ-ও জানান সে কাজ শিবমের। শিবম অবশ্য অমলাকে জানায়, তারা মনোজকে হাসপাতালে ভর্তি করে এসেছিল। পরে মনোজ ভাল হয়ে হাসপাতাল থেকে চলে গিয়েছে।

ফের বাড়ি ফিরে আসেন অমলা। বলেন, “ভাবলাম হয়তো কোনও আত্মীয়ের বাড়ি চলে গিয়েছে। মাঝেমধ্যেই মনোজ বাড়ি না ফিরে আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যেত। সেই মতো আমার আত্মীদের কাছে খোঁজখবর করি। কোথাও সন্ধান পাইনি। তখনই পাড়ার ছেলেদের সবটা খুলে বলি।”

এর পরই বৃহস্পতিবার সকালে পাড়ার ছেলেরা গাড়ি করে মাইক নিয়ে শুরু করে প্রচার। এরই মধ্যে পুলিশ প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার রাতেই পূর্বপাড়া ও দুর্গাপুরের মাঝখানে একটি পাট খেতে তল্লাশি করে। মৃতদেহের সন্ধান মেলেনি। পরে টানা জেরা করার পরে শনিবার ভোরের দিকে ভেঙে পড়ে শিবম। নিজেদের অপরাধের কথা স্বীকার করে নেয়। পুলিশ তাকে নিয়ে যায় ওই মাঠে। তার দেখিয়ে দেওয়া পথেই পুলিশ শেষ পর্যন্ত মনোজের পচাগলা দেহ উদ্ধার করে। পরে মনোজের পরিবারের লোকজনও তা শনাক্ত করেন। এর পর মনোজের মা অমলাদেবী পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মোট আট জন যুবকের বিরুদ্ধে খুন ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ শিবম পোদ্দার-সহ অলোক বিশ্বাস ও সুমন বৈদ্যকে গ্রেফতার করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mentally ill youth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE