কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে যখন পড়তাম (১৯৫১-৫৫), আইএ ও বিএ ক্লাসে, তখন আমরা প্রিয় শিক্ষক ছিলেন চিন্তাহরণ চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন বাংলার বিভাগীয় প্রধান। সংস্কৃত ও বাংলায়-দুটিতেই ছিলেন এমএ, দু’টি বিষয়েই ফার্স্ট ক্লাসই শুধু নয় প্রথমও। পরে তিনি এখান থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে চলে গিয়েছিলেন। শিক্ষক হিসাবে তাঁর কাছে আমার ঋণ সব চাইতে বেশি। পাঠ্য বহির্ভূত বহু বিষয়ই পড়াতেন। যার মধ্যে সংস্কৃত কাব্য, বাংলা টাইপ, কিছুই বাদ যেত না। প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’ (১৮১৮), তা-ও ওঁর কাছ থেকেই পড়া। রোমান হরফে ছাপা প্রথম বাংলা বই যা বেড়িয়েছিল পর্তুগাল থেকে। সেই সব বই-পত্রিকা তিনি আমাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে দেখাতেন।তিনি আমাকে রোমান হরফ শেখান। আমি যখন কৃষ্ণনগর গভর্ণমেন্ট কলেজের ছাত্রসংসদের পত্রিকা সম্পাদক ছিলাম তখন তিনি ছিলেন তত্বাবধায়ক। তার কাছ হাতে কলমে শিখেছি প্রুফ দেখা। প্রেসের কাজও শিখেছি। এমনকী, কম্পোজ করাও শিখিয়েছিলেন হাতে ধরে। এখনকার বঙ্গরত্ন প্রেসে তাঁর কাছ থেকে প্রেসের নানারকম খুটিনাটি কাজের হাতেখড়ি। তাঁর বাড়িতে অনেক দুর্লভ বই ছিল। যা তিনি আমাকে পড়তে দিতেন। এমন শিক্ষক এখনকার দিনে আর তৈরি হয় না। সেই সব মাস্টারমশাই, বাবলেই...। তবে মানুষটার জীবন ছিল অনাড়াম্বর। সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি। ওঁদের, সে সময়ে মাইনে আর কত ছিল, সামান্য। কিন্তু অসম্ভব মানসিক সমৃদ্ধি ছিল। তিনি অনেক বহু বইও সম্পাদনা করেছেন। কী বলব, তন্ত্রশাস্ত্রেও অনেক দক্ষতা ছিল। আশি বছর আগে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় তিনি নদিয়ার ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন, যা আজও অদ্বিতীয়। যখন অধ্যাপনা শুরু করি, তখনও তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে যেতাম। তিনি বলছেন, “প্রথম দশ বছর মন দিয়ে অধ্যাপনা কর। তার পরে গবেষণা করবে।” তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। তিনি বলতেন, “যে সব কাজ করবে তা যেন স্থায়ী হয়।” আমি সারাটা জীবন চেষ্টা করেছি তাঁর সেই উপদেশই মান্য করতে।
সুধীর চক্রবর্তী, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy