Advertisement
E-Paper

‘মনে আগুন লেগেছে, পারবেন নেভাতে?’

ফোনটা এসেছিল রাত এগারোটা নাগাদ। একটা রিং হতেই ডিউটি অফিসার তড়িঘড়ি রিসিভার তুলেছিলেন, ‘‘নমস্কার, কোতোয়ালি থানা...।’’ ফোনের ও প্রান্ত কিছুক্ষণ চুপ। তারপর জড়ানো গলায় ভেসে এল, ‘‘দু’টো দিশি আর এক প্যাকেট ডালমুট, পাঁচ মিনিটের মধ্যে।’’

শুভাশিস সৈয়দ ও সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৫১

ফোনটা এসেছিল রাত এগারোটা নাগাদ।

একটা রিং হতেই ডিউটি অফিসার তড়িঘড়ি রিসিভার তুলেছিলেন, ‘‘নমস্কার, কোতোয়ালি থানা...।’’

ফোনের ও প্রান্ত কিছুক্ষণ চুপ। তারপর জড়ানো গলায় ভেসে এল, ‘‘দু’টো দিশি আর এক প্যাকেট ডালমুট, পাঁচ মিনিটের মধ্যে।’’

বহরমপুর দমকলে ফোনটা এসেছিল আরও রাতে।

টেলিফোনের পাশে বসে খবরের কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখছিলেন এক কর্মী। ফোনের ও প্রান্তে মহিলা কন্ঠ, ‘‘পুড়ে সব ছারখার হয়ে গেল। শিগ্‌গির আসুন।’’

দমকল কর্মীর গলায় ষোলো আনা উদ্বেগ, ‘‘কোথায় আগুন? এলাকাটা বলুন...।’’

উত্তর এল, ‘‘মনে আগুন লেগেছে। পারবেন নেভাতে?’’

কৃষ্ণনগর জেলা সদর হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মোবাইলটা বেজে উঠেছিল রাত একটায়। এত রাতে ফোন? রোগীর অবস্থা কি খারাপ? ধড়মড়িয়ে উঠে ফোনটা রিসিভ করতেই ও প্রান্ত থেকে এক তরুণী জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘প্রেম-জ্বরের ওষুধ মিলবে, ডাক্তার?’’

এমন ফোনের গুঁতোয় দুই জেলা জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব।

পুলিশকর্মী গলা চড়িয়েছেন, ‘‘তোর কী করি দ্যাখ!’’ দমকলকর্মীর অনুনয়, ‘‘জরুরি নম্বর। এটাকে নিয়ে মজা করবেন না প্লিজ।’’ চিকিৎসকের দাওয়াই, ‘‘আপনার জন্য আরও বিপদে পড়তে পারে রোগী ও তাঁর বাড়ির লোকজন।’’

কিন্তু ওই পর্যন্তই! কাজের কাজ কিস্যু হয়নি।

কৃষ্ণনগরের জেলা হাসপাতালের দু’টি ক্যাম্পাসে একাধিক জায়গায় বোর্ড টাঙিয়ে প্রচার করা হয়েছে একটি মোবাইল নম্বর। চিকিৎসা পরিষেবা সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর জন্যই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে মাস কয়েক আগে। কিন্তু কাজের থেকে অকাজের ফোনই সেখানে বেশি আসছে বলে অভিযোগ।

জেলা হাসপাতালের এক কর্তার আক্ষেপ, ‘‘মানুষ আর কবে সচেতন হবে বলুন তো?’’

পুলিশ ১০০, দমকল ১০১ এর মতো টোল ফ্রি নম্বরগুলোও চালু হয়েছিল নিখরচায় জরুরি পরিষেবা দেওয়ার জন্য। অথচ সেই সুবিধারও চূড়ান্ত অপব্যবহার করেছেন কিছু লোকজন। কিন্তু ফোনগুলো থানায় কিংবা দমকলে আসছে কী ভাবে?

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, টোল ফ্রি ১০০ নম্বর ডায়াল করলেই ফোন চলে যাওয়ার কথা স্থানীয় থানায়। যেহেতু ওই নম্বর টোল ফ্রি, তাই যে কেউই যখন তখন মোবাইল কিংবা ল্যান্ডফোন থেকে এ ভাবে ফোন করে বিরক্ত করছে। একই ভাবে ১০১ ডায়াল করলেই সেই ফোন যাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার দমকল দফতরে।

বহরমপুর থানার এক পুলিশকর্মী বলছেন, “ধরুন, প্রথম ফোনটা এল অমুক জায়গায় গোলমাল। ঠিক তার পরের ফোনটা এল পঞ্চাশ টাকা রিচার্জ করে দেওয়ার জন্য। কাজের সময় এ সব কারও ভাল লাগে?”

দিনকয়েক আগে করিমপুর দমকলে ফোন এসেছিল। রাতেই। না কোনও আবেদন-নিবেদন নয়। নিখাদ জরুরি গলায়, ‘‘ফায়ার স্টেশন? আগুন লেগেছে। তাড়াতাড়ি আসুন।’’ মুহূর্তে সেই এলাকায় পৌঁছে গিয়েছিল দমকলের গা়ড়ি। কিন্তু কোথায় আগুন? দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে ছিল পাড়া।

অতএব পালে বাঘ পড়ার গল্প মাথায় রেখেও ছুটতে হচ্ছে পুলিশ কিংবা দমকলকে। দমকল ও পুলিশ কর্তাদের কথায়, ‘‘তাছাড়া উপায় কী বলুন? সত্যিই যদি বিপদ ঘটে যায় তার দায় কে নেবে?’’

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায় বলছেন, “হাসপাতালের এই ফোন নম্বরকে জীবনদায়ী নম্বর হিসাবেই ভাবা দরকার। সকলের কাছে আমাদের অনুরোধ এর অপব্যবহার করবেন না।’’

দমকল ও থানার ল্যান্ড নম্বরে কলার লাইন আইডেন্টিফিকেশন (সিএলআই) লাগানো থাকে। সেই নম্বরের সূত্র ধরেও কিছু কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। তবে এই প্রবণতা কমেনি। কিন্তু এমন ফোনের কারণ কী? নদিয়া জেলা পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, কেউ ফোন করেন নিছক মজার জন্য। কেউ আবার বিব্রত করেই আনন্দ পান। কিন্তু তার পরিণতি যে কী হতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁদের ন্যূনতম সচেতনতা থাকলে এমনটা তাঁরা করতেন না।

বহরমপুর দমকলের ওসি সুখেন সরকারও বলছেন, “থানা-পুলিশ করেও বিশেষ লাভ হয়নি। মানুষ সচেতন না হলে এই বদ অভ্যাস বন্ধ করা কঠিন।”

তবে মনোবিদরা এই প্রবণতাকে এত সহজে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান রঞ্জন ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, তিনটে কারণে মানুষ এমন ফোন করে থাকেন— ১) একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গতা থেকে অনেকে ফোন করে থাকেন। এর পিছনে মানসিক অবসাদ অন্যতম কারণ।

২) কারও দেওয়া ভুল তথ্যের জেরে সোরগোল পড়ে গেল। তখন সেই মানুষটি আনন্দ পান এই ভেবে যে, তিনি গুরুত্ব পেলেন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় নার্সিসিস্টিক পার্সোন্যালিটি ডিসঅর্ডার। ৩) অসামাজিক কারণেও অনেকে ফোন করে থাকেন।

রঞ্জনবাবু বলছেন, ‘‘উপযুক্ত চিকিৎসা ও সচেতনতাই এর একমাত্র দাওয়াই।’’

সেই ওষুধ যতদিন না পড়ছে ততদিন কে নেভাবে মনের আগুন?

Toll free number Police station
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy