উৎসব মানেই এলাকার যুবকদের বাড়তি দায়িত্ব। চাঁদা তোলা থেকে পুজোর যোগাড়, প্রসাদ বিতরণ থেকে যাত্রা-বাউলের আসর বসানো— সবেতেই তো পাড়ার যুবকরাই ভরসা। কিন্তু, নোটের গুঁতোয় সুতির রাস উৎসবে ঘুম ছুটেছে পাড়ার যুবকদের।
মণ্ডপ ছেড়ে সাতসকালে তাঁদের লাইন দিতে হচ্ছে ব্যাঙ্কের সামনে। বাজেট চার লক্ষ টাকা। টাকা তো রয়েছে। কিন্তু, সে সবই পুরনো নোট। আপাতত তা বাতিলের খাতায়।
সুতির নতুন পারুলিয়ার রাস উৎসবের বাজেট চার লক্ষ টাকার। বাজেট সামাল দিতে বাতিল নোট ভাঙাতে গত পাঁচ দিন ধরে গ্রাম লাগোয়া গ্রামীণ ব্যাঙ্কে লাইন দেওয়ার ডিউটি বেঁধে দেওয়া হয়েছে রাস কমিটির যুবকদের। কিন্তু গত দু’দিন ধরে ব্যাঙ্কে টাকা না আসায় খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে তাঁদের।
প্রতিমার দাম, রান্না-বান্নার আনাজপাতি, প্যান্ডেল সবেতেই আপাতত ধার রাখা গেলেও পালা কীর্তন-বাউল-কবিগানের বহিরাগত শিল্পীদের টাকা মেটাতে বুধবার পর্যন্ত কালঘাম ছুটেছে তাঁদের।
রাস কমিটির সম্পাদক চন্দ্রশেখর দাস বলছেন, “গ্রামের কারও কাছে টাকা ধার নেব সে রাস্তাও বন্ধ। সবার ঘরেই বাতিল পুরোনো নোট। শিল্পীরা কেউই তা নিতে চাইছেন না।’’ এরই মধ্যে ঘাড়ে এসে পড়েছে নতুন দায়। বৃহস্পতিবার কলকাতার একটি নামী দলের যাত্রাপালার জন্য মেটাতে হবে ৫০ হাজার টাকা। তাও আবার নগদে নতুন নোটে। বিকেল পর্যন্ত ব্যাঙ্কে সেই নোটের দেখা নেই।
১৮ বছর ধরে চলা নতুন এই উৎসবে এমন সঙ্কট কখনও আসেনি। দিনে দিনে উৎসবের বাজেট বেড়েছে। গ্রামের প্রায় দেড়শো পরিবারের বেশিরভাগই অনেক আগেই মিটিয়ে নগদে চাঁদা মিটিয়ে দিয়েছেন। সবই পুরনো নোট।
বছর পঁচাত্তরের মহাফল দাস জানাচ্ছেন, শুধু উদ্যোক্তারাই সঙ্কটে পড়েছেন তা নয়। মেলায় একশ’রও বেশি দোকান বসে। রোজ ২৫-৩০ হাজার মানুষের ভিড় হয়। এ বার মেলায় অর্ধেক ভিড়ও নেই। দোকানের সংখ্যাও নেমে এসেছে ৪৫-এ। সেগুলিতেও যে বেচাকেনা নেই বললেই চলে।
তবে উদ্যোক্তাদের স্বস্তি একটাই। স্থানীয় বাজারে ধার পেতে অসুবিধা হচ্ছে না। এত দুর্ভোগেও অবশ্য উদ্যোক্তারা বড় নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে সমর্থনই করছেন। কমিটির অন্যতম কর্তা সঞ্জয়কুমার দাস জানালেন, শেষ মুহূর্তে খরচে লাগাম টানতে হয়েছে বলে অন্যান্যবারের মত আলোকসজ্জা নেই। বিদ্যুতের সংযোগ না নিয়ে ৬টি জেনারেটর ভাড়া করা হয়েছে। খরচ সামলাতে নোট সংগ্রহে সমস্যা হচ্ছে। টাকা না মেটাতে পেরে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘তবু আমরা নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলেই মনে করি। এর ফলে বাড়ির পাশ দিয়ে শয়ে শয়ে গরুর পাচার বন্ধ হয়েছে। বাজারে সব্জির দাম কিছুটা কমেছে।”
দুর্গাপুজো নেই গ্রামে। নেই কালী পুজোও। তাই এই গ্রামে রাসই প্রধান উৎসব। প্রতিটি বাড়িই আত্মীয় পরিজনদের ভিড়ে সরগরম। উৎসব কমিটির সভাপতি দুখুলাল দাস জানান, গ্রামে অধিকাংশই চাষি গেরস্তের বাস। পুজো বলতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। বছর ১৮ আগে হঠাৎই গ্রামে আসেন ঝাড়খন্ডের এক সন্যাসী। তিনিই এই রাস উৎসবের সূচনা করেন।
দুখুলালবাবু বলছেন, “গ্রামে রাজনীতি আছে। যে যার মত দল করেন। কিন্তু রাস মঞ্চে সব একাকার। গ্রাম কমিটি গড়ে উঠেছে। পরিবেশের সুরক্ষায় গ্রাম এখনও মদ, জুয়ার কুপ্রভাব থেকে মুক্ত।”
রাস উতসবকে গ্রাম সাজানো হয়েছে ৬০টি মূর্তি দিয়ে। কোথাও রয়েছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম পর্ব, গোপিনীদের বস্ত্র হরণ। কোথাওবা গৌরাঙ্গ ও চৈতন্য মহাপ্রভুর লীলা কীর্তি তুলে ধরা হয়েছে মাটির মূর্তি দিয়ে সাজিয়ে।
চন্দ্রশেখরবাবুর দাবি, রাস উৎসবের উদ্দেশ্য প্রেম, প্রীতি ও মৈত্রীর বার্তা সকলের কাছে তুলে ধরা। মেলাকে ঘিরে চলছে বাউল, কবিগান, যাত্রা। উদ্দেশ্য বাংলার লোকসংস্কৃতিকে মর্যাদা দেওয়া।
বৃহস্পতিবার গ্রামের রাসমেলায় চলছে একদিকে যাত্রার আয়োজন , অন্যদিকে শুক্রবার দুপুরে রাসের ৬০টি মূর্তি নিয়ে বিসর্জনের প্রস্তুতি। হাত টান, তবু খামতি নেই কোনো প্রস্তুতিতেই।
সেই প্রস্তুতির অন্যতম এ বার ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দেওয়া। জনা দসেখ যুবককে লাইনে দাঁড়া করানো হচ্ছে রোজই। যদি পুরনো নোট বদলানো যায়। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত শিকে ছেড়েনি তাঁদের।