৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে তখন আটকে পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি। সোমবার সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
গাংনাপুরের কনভেন্ট স্কুলে ডাকাতি ও বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর ধর্ষণের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরেও গ্রেফতার হয়নি কোনও দুষ্কৃতী। এ নিয়ে স্থানীয় মানুষের ক্ষোভের আঁচ সোমবার ছুঁয়ে গেল খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আক্রান্ত স্কুল এবং রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সন্ন্যাসিনীকে দেখে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ কলকাতা ফেরার পথে মিশন গেট এলাকায় উত্তেজিত জনতার অবরোধে আটকে পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়।
স্কুলের চার জন পড়ুয়ার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আলাদা করে কথা বললেও সমস্যা মেটেনি। উল্টে জমায়েত থেকে আচমকা উড়ে আসে ‘গো-ব্যাক’ স্লোগান। পুলিশ ভিড় সরানোর চেষ্টা শুরু করলে অবরোধকারীরা বসে পড়েন রাস্তায়। এ বার মুখ্যমন্ত্রী মাইক টেনে নিয়ে অভিযোগ করেন, ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে মিশে বিজেপি এবং সিপিএম গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করছে। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তিনি বলেন, যত ক্ষণ অবরোধ চলে চলুক। তিনিও নড়বেন না। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে প্রায় এক ঘণ্টা গাড়িতেই বসে থাকেন মমতা।
তার পর হঠাৎই খবর রটে রাস্তার লাগোয়া চেতনা মাঠে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ শুনবেন মুখ্যমন্ত্রী। জনতা রাস্তা ছেড়ে ভিড় করতে থাকে মাঠে। ভিড় একটু হাল্কা হতেই পুলিশ তড়িঘড়ি মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় রওনা করিয়ে দেয়।
মুখ্যমন্ত্রী চলে যাওয়ার পরে ফের শুরু হয় অবরোধ। এ বার জাতীয় সড়কের সঙ্গে সঙ্গে শিয়ালদহ-রানাঘাট শাখার রেল লাইনেও। জেলার আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা। শেষ পর্যন্ত রাত পৌনে দশটা নাগাদ অবরোধ উঠে যায়। যদিও ক্ষোভ মেটেনি গাংনাপুরের। এ দিনের জমায়েত থেকে দাবি উঠেছে, তদন্তের ভার সিবিআই-কে দিতে হবে।
শুক্রবার রাতের ঘটনার পরে সোমবার রাত পর্যন্ত কোনও দুষ্কৃতীকেই গ্রেফতার করতে পারেনি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া রাজ্য পুলিশের অধীনস্থ সিআইডি। তাদের তরফে অগ্রগতি বলতে সিসিটিভির ফুটেজ থেকে চার দুষ্কৃতীর ছবি ও বাকি তিন দুষ্কৃতীর স্কেচ প্রকাশ করা। এ ছাড়া, স্থানীয় জনা দশেক সন্দেহভাজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ। রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল জিএমপি রেড্ডি এ দিন ঘটনাস্থল ঘুরে শুধু বলেন, ‘তদন্ত চলছে’।
অথচ ঘটনার পরের দিন, অর্থাৎ শনিবার সকালে বিক্ষোভরত ছাত্র ও স্থানীয়দের পুলিশ আশ্বাস দেয়, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করা হবে। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে সে দিনও জাতীয় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করা হয়েছিল। পুলিশের আশ্বাস পেয়ে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পরে ওঠে সেই অবরোধ।
কিন্তু পুলিশ কথা রাখতে না-পারায় ফের ক্ষোভ ছড়ায় গাংনাপুরে। ইতিমধ্যে খবর আসে মুখ্যমন্ত্রী আসছেন। সে কথা শুনে এ দিন দুপুর থেকেই স্কুল চত্বরে ভিড় করেছিল পড়ুয়ারা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন স্কুলের প্রাক্তনীরাও। কথা ছিল, মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে রেখেই মোমবাতি মিছিল করবেন তাঁরা। কিন্তু বিকেল ৫টা বেজে গেলেও মুখ্যমন্ত্রীর দেখা মেলেনি। ফলে মিছিল শুরু হয়ে যায়। তাতে একে একে এসে মেশে আশপাশের তাহেরপুর, বীরনগর, বাদকুল্লার বাসিন্দাদের দীর্ঘ মিছিল। স্কুলপড়ুয়া থেকে বয়স্ক মানুষ কারও প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘উই ওয়ন্ট জাস্টিস’, কারও প্ল্যাকার্ডে আবার লেখা ‘অকর্মা পুলিশ’।
পথে প্রতিবাদে। রানাঘাটের ধর্ষণের ঘটনায় পার্ক স্ট্রিটে বিক্ষোভ মিছিল।
সোমবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
তত ক্ষণে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছে গিয়েছেন ওই স্কুলে। বিকেল ৫টা ২৫ নাগাদ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরেই কনভয় থামিয়ে স্কুলে ঢুকে পড়েন তিনি। রাস্তায় তখন জমাট ভিড়। সেখান থেকে উড়ে আসে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান। মিনিট পাঁচেক স্কুলে কাটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পায়ে হেঁটেই রওনা দেন দেড় কিলোমিটার দূরের রানাঘাট মহকুমা হাসপাতালের দিকে। তত ক্ষণে যানজটে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। তার মধ্যেই কখনও থমকে কখনও ভিড় করা জনতাকে মৃদু ধমক দিয়ে হাঁটতে থাকেন মমতা।
হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মিনিট কুড়ি। হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়েই ঘোষণা করেন, “সিস্টার ইজ অলরাইট নাউ।... কয়েক জন অ্যারেস্ট হয়েছে। পুরো গ্যাংটা ধরার চেষ্টা চলছে। স্ট্রং অ্যাকশন নেওয়া হবে।” তবে মুখ্যমন্ত্রী বললেও কোনও দুষ্কৃতীর গ্রেফতার হওয়ার খবর রাত পর্যন্ত নেই। উল্টে সিআইডির একটি সূত্রের খবর, ডাকাত দলের অন্তত তিন জন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য শুনে ভ্রূ কুঁচকে যায় সেখানে ভিড় করে থাকা জনতার। ফের স্লোগান উড়ে আসে ‘গো ব্যাক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’।
জাতীয় সড়ক জুড়ে ভিড় ছিলই। কিন্তু মহকুমা হাসপাতাল থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে, স্কুলের কাছাকাছি মিশন গেট এলাকায় এসে আটকে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়। সামনে স্কুলপড়ুয়া ও জনতার অবরোধ। প্রায় দশ মিনিট আটকে থাকার পরে পিছনের গাড়িতে থাকা ডিজি-কে ডেকে পাঠান মমতা। নির্দেশ দেন চার জন পড়ুয়াকে ডেকে নেওয়ার। তাদের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। মিনিট কয়েকের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির জানলার সামনে ভিড় করে জনা কয়েক পড়ুয়া। মুখ্যমন্ত্রীকে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কথা বলে তারা। জানায়, বারো কিলোমিটার দূরের গাংনাপুর থানা থেকে পুলিশ ওই দিকে প্রায় আসেই না। একের পর এক চুরি-ডাকাতির ঘটনা হলেও সাকুল্যে পঞ্চাশ মিটার দূরের রানাঘাট থানা মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। পড়ুয়ারা আরও দাবি জানায়, মুখ্যমন্ত্রী পাশের মাঠে চলুন। সেখানে দাবিদাওয়া নিয়ে তাদের আরও কিছু বলার আছে।
ইতিমধ্যে অবরোধকারী জনতাকে সরাতে অনুরোধের পথ ছেড়ে জোর করতে শুরু করে পুলিশ। তাতে আরও তেতে ওঠে এলাকা। এই সময়ে পুলিশের মাইক টেনে নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, “আমি সরি। আমাদের বিরোধী দলের কয়েক জন লোক আছেন যারা এই নুইসেন্স তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তাঁরা চান না, আসল দুষ্কৃতীরা ধরা পড়ুক। আমরা আসল দুষ্কৃতীকে ধরব। তাদের বিরুদ্ধে স্ট্রং অ্যাকশন হবে। আমি এটাও বলব, এমন কিছু করবেন না যাতে ঘটনাটি কলঙ্কিত করা হয়। মিশনারি সব সময়ে শান্তির প্রতীক। আমি দেখছি, চার-পাঁচ জনকে এখানে, যারা রাজনৈতিক দলের রঙ দিয়ে ঘটনাটিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছেন।”
মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনেও জনতা নড়েনি। এই সময়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ফের বলতে শোনা যায়, “আমাকে এ ভাবে আটকে রেখে লাভ নেই। আমি রইলাম। কত ক্ষণ করতে পারেন করুন। দেখি, কত ক্ষণ করতে পারেন অসভ্যতামি। বিজেপি আর সিপিএম পার্টিকে বলুন কত ক্ষণ বুকের পাটা আছে! সিপিএম আর বিজেপিকে আমি চ্যালেঞ্জ করছি। আমি আন্দোলনের লোক। আমি আপনাদের ডরাই না। আমি এখানে অপেক্ষা করছি। মারার ক্ষমতা থাকলে আসবেন। গায়ে হাত দেবেন। অপেক্ষা করছি এখানে।”
পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠতে থাকে। ‘গো ব্যাক’ স্লোগানের সঙ্গেই এ বার ‘মমতা ব্যানার্জি জিন্দাবাদ’ও ভেসে আসতে থাকে। খ্রিস্টান ধর্মের কিছু নেতাও জনতাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। তাতে লাভ হয়নি। মিনিট পঁচিশ এ ভাবেই চলার পরে আচমকাই রটে যায়, পাশের চেতনা মাঠে গিয়ে ক্ষুব্ধ জনতার কথা শুনবেন মমতা। ভিড় এ বার পাতলা হতে থাকে। মাঠের দিকে হাঁটতে থাকে জনতা। আর সেই অবসরে পুলিশ বের করে দেয় মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়।
তবে মমতা বেরিয়ে গেলেও অবরোধ ওঠেনি। অবরোধকারীদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, “উনি নিজেকে আন্দোলনের লোক বলছেন। আমরা তো আন্দোলনই করছিলাম!” কারও ক্ষোভ, “মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশই এ দিন আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে বাধা দিল।”
তৃণমূলের দাবি, এ দিনের ভিড়ে পড়ুয়া ছাড়াও বেশ কিছু রাজনৈতিক মুখ দেখা গিয়েছে। তারাই ছাত্রছাত্রী, প্রাক্তনীদের ভিড়ে মিশে দল ভারী করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পড়ুয়াদের উস্কেছে। তবে পরিস্থিতির জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টা দায়ী করেছেন এ রাজ্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী প্রকৃত দুষ্কৃতীদের ধরার বদলে বিজেপিকে দুষছেন। এর ফলে বিজেপিকে নিয়ে ওঁর অস্বস্তিটাই প্রমাণ হয়। বিজেপিকে দোষী করে উনি নিজের সরকারের ত্রুটি ঢাকতে পারেন না। দোষীদের ধরার যে দাবি ছাত্রছাত্রীরা তুলেছিল, তা অসঙ্গত ছিল না।” এ দিন সন্ধ্যায় পায়রাডাঙা এবং রানাঘাটে তাদের দু’টি কার্যালয়ে তৃণমূল সমর্থকেরা ভাঙচুর চালিয়েছে বলে বিজেপি-র অভিযোগ।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “উনি (মুখ্যমন্ত্রী) গিয়ে সমাধানের বদলে ভাষণ দিয়ে সমস্যা আরও জটিল করে ফিরে এলেন। এই ক্ষোভ এর পরে আর শুধু রানাঘাটে সীমাবদ্ধ থাকবে না।”
কলকাতার আর্চবিশপ টমাস ডি সুজার দাবি, “ঘটনাটি এতটাই খারাপ উদাহরণ তৈরি করেছে যে, পড়ুয়ারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই ঘটনায় যে অভিযুক্তেরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমরা চাই, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক।”
তিনি জানান, প্রশাসনের উপর এখনও তাঁর আস্থা রয়েছে। তবে একই সঙ্গে তিনি যোগ করেন, “এ কথা অবশ্য ঠিক যে পুলিশ-প্রশাসন সময় মতো ব্যবস্থা নিলে এই ঘটনাটি হয়তো এড়ানো যেত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy