Advertisement
E-Paper

বিক্ষোভে কারা, ফর্দ তৈরিতে ব্যস্ত তৃণমূল

অপরাধীরা এখনও অধরা। তাদের গ্রেফতারের দাবিতে গত চার দিন মাঠে নামেনি তৃণমূল। কিন্তু সোমবার রানাঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভের পরেই সেই ঘটনার পিছনে কারা, তার খোঁজে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল শাসক দল! মঙ্গলবার তারা এলাকায় বড়সড় মিছিল বের করে ফেলেছে। মিছিলে জ্বলজ্বল করেছে ‘বিজেপি-হার্মাদ অশুভ আঁতাঁত ধ্বংস হোক’ জাতীয় অজস্র প্ল্যাকার্ড।

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৩:২০
এ বার মিছিল নবগ্রামে। রানাঘাটে সন্ন্যাসিনী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বিকেলে পথে নামলেন স্থানীয় মহিলা ও পড়ুয়ারা। প্ল্যাকার্ডে, পোস্টারে ছয়লাপ সেই মিছিল থেকে উঠে এল রাজ্যের ক্রম ক্ষয়িষ্ণু নারী-নিরাপত্তার প্রশ্ন। ছবিটি তুলেছেন গৌতম প্রামাণিক।

এ বার মিছিল নবগ্রামে। রানাঘাটে সন্ন্যাসিনী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার বিকেলে পথে নামলেন স্থানীয় মহিলা ও পড়ুয়ারা। প্ল্যাকার্ডে, পোস্টারে ছয়লাপ সেই মিছিল থেকে উঠে এল রাজ্যের ক্রম ক্ষয়িষ্ণু নারী-নিরাপত্তার প্রশ্ন। ছবিটি তুলেছেন গৌতম প্রামাণিক।

অপরাধীরা এখনও অধরা। তাদের গ্রেফতারের দাবিতে গত চার দিন মাঠে নামেনি তৃণমূল। কিন্তু সোমবার রানাঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভের পরেই সেই ঘটনার পিছনে কারা, তার খোঁজে কোমর বেঁধে নেমে পড়ল শাসক দল! মঙ্গলবার তারা এলাকায় বড়সড় মিছিল বের করে ফেলেছে। মিছিলে জ্বলজ্বল করেছে ‘বিজেপি-হার্মাদ অশুভ আঁতাঁত ধ্বংস হোক’ জাতীয় অজস্র প্ল্যাকার্ড।

ঘেরাওয়ের মুখে পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে এসেছিলেন, এ কাজ সিপিএম এবং বিজেপি-র। তাঁর পথে হেঁটেই এখন বিজেপি এবং সিপিএমের রাজনৈতিক ‘চক্রান্ত’কে সামনে আনতে মরিয়া নদিয়া তৃণমূল। রীতিমতো তালিকা তৈরি করে ফেলা হয়েছে বিক্ষোভকারীদের! দলের জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের কথায়, “যারা এটা ঘটিয়েছে, তৃণমূল তাদের সাংগঠনিক ভাবে চিহ্নিত করে মোকাবিলা করবে।”

রানাঘাট নিয়ে রাজনীতির চাপানউতোর মঙ্গলবার পৌঁছে গিয়েছে দিল্লিতেও। লোকসভায় বিজেপি এবং সিপিএম সাংসদেরা যেমন তৃণমূলকে আক্রমণ করেছেন, তেমনই তৃণমূল পাল্টা দায় চাপিয়েছে বিজেপির ঘাড়ে। ঘটনার বিচারের দাবিকে পিছনে ঠেলে রাজনৈতিক তরজা যে ভাবে বড় হয়ে উঠছে, সে জন্য উষ্মাও প্রকাশ করেছেন লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন।

রানাঘাটে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা অবশ্য মৌখিক চাপানউতোর থেকে আরও এক কদম এগিয়ে! দলীয় সূত্রের বক্তব্য, সোমবার রাতেই মুখ্যমন্ত্রী পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন দলীয় নেতাদের। সেই মতোই জেলা তৃণমূলের তরফে ১১ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে চার জন মহিলার নামও আছে। জেলার এক নেতা বলেন, “এই তালিকায় দু’জন বিজেপি কর্মী, বাকিরা সিপিএমের।”

যদিও জেলা তৃণমূলের একটি অংশের বক্তব্য, রানাঘাটে বিজেপির তেমন অস্তিত্ব নেই। আর সিপিএমের এখন যা সাংগঠনিক শক্তি তাতে তাদের পক্ষে এত দ্রুত এত বড় বিক্ষোভ করা সম্ভব নয়। বরং যে এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে, সেই মিশন গেট চত্বরে বেশ কয়েক জন মুকুল-ঘনিষ্ঠ নেতা রয়েছেন। তাঁদের কয়েক জন সোমবারের মিছিল ও বিক্ষোভে ছিলেন বলেও ওই তৃণমূল নেতাদের দাবি। তাঁরা বলছেন, নন্দীগ্রামে দলেরই বিক্ষোভের মুখে পড়ে ফিরে আসতে হয়েছিল মুকুলকে। দু’দিনের মধ্যে একই অস্ত্র মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছেন তাঁর অনুগামীরা। সোমবারের বিক্ষোভে মুকুল রায়ের অনুগামীরা ছিলেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে গৌরীবাবু বলেন, “তৃণমূলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী ছাড়া অন্য কারও অনুগামী নেই। আগে যদি কেউ থেকেও থাকেন, এত দিনে তাঁরা বিজেপির শরণার্থী হয়ে গিয়েছেন!”

১) কনভেন্টে ঢুকে দারোয়ানকে বেঁধে ফেলল দুষ্কৃতীরা। ২) একটি ঘরের মধ্যে ঢোকানো হল সন্ন্যাসিনীদের।
৩) লকার ভেঙে লুঠ করা হল প্রচুর টাকা। ৪) দুষ্কর্মের ফাঁকে ফ্রিজ খুলে কলা-রুটি খেল তারা। অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।

তৃণমূল সূত্রের অবশ্য খবর, রানাঘাট ও আশপাশের এলাকায় মুকুল-ঘনিষ্ঠদের ভূমিকা খতিয়ে দেখে দ্বিতীয় একটি তালিকাও তৈরি হচ্ছে। দু’টিই দলনেত্রীর কাছে পাঠানো হবে। দলের ওই অংশের বক্তব্য, রবিবার বিকালেই কাঁচরাপাড়ায় মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশুর সঙ্গে রানাঘাট ও আশপাশের বেশ কিছু তৃণমূল নেতার বৈঠক হয়। সেখানে তৈরি ছক অনুসারেই মুকুল-ঘনিষ্ঠেরা লোক ঢুকিয়েছিলেন মিছিলে। মিশন গেট এলাকায় অপেক্ষায় ছিল আরও কিছু লোক। মুখ্যমন্ত্রী সেখানে এসে পৌঁছতেই তারা একযোগে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। তৃণমূল নেতাদের দাবি, শুভ্রাংশুর বৈঠকে এমন এক ব্যক্তি হাজির ছিলেন, যিনি মিশন গেট এলাকায় প্রভাবশালী। রানাঘাট-২ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সদস্য, একদা শঙ্কর সিংহের ডান হাত বলেও পরিচিত। পরে তিনি মুকুলের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেন। বিক্ষোভে প্রথম দিকে তিনি না-থাকলেও পরে তাঁকে দেখা যায়। রানাঘাট শহর তৃণমূল নেতাদের দাবি, ওই এলাকায় তাঁর অঙ্গুলিহেলন ছাড়া এত বড় ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়। সিপিএম থেকে মুকুলের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেওয়া এক বহিষ্কৃত যুব নেতার ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁকে তৃণমূলের যুব সংগঠনের জেলা সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী কালে খুন ও জালনোট চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তখন তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তার পরেও মুকুলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। রানাঘাটের স্কুলে ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে রবিবার তাঁকে আটকও করেছিল পুলিশ। পরে অবশ্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সোমবার বিকেলে যে মিছিলটি মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল সেই মিছিলেও ওই নেতাকে দেখা যায়, দাবি তৃণমূল নেতাদের একাংশের।

তাঁরা আরও বলছেন, সাংগঠনিক ভাবে এই ঘটনায় মুকুল-ঘনিষ্ঠেরা জড়িত বলে চিহ্নিত করা হলেও প্রকাশ্যে তা স্বীকার করা হবে না। বরং, তাঁদের বিজেপি বলেই চিহ্নিত করা হবে। কারণ, মুকুল-ঘনিষ্ঠেরা এ কাজ করেছেন বলে সরাসরি মেনে নিলে দলে তাঁর প্রভাবই স্বীকার করে নেওয়া হয়! নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জেলা নেতার কথায়, “দলের সঙ্গে মুকুলের দূরত্ব তৈরি হওয়ার পরে জেলায় তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে সে রকম প্রতিক্রিয়া না দেখে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন দলের জেলা নেতৃত্ব। সোমবারের ঘটনা সেই আত্মতুষ্টিতে একটা বড়সড় ধাক্কা বলা যেতে পারে!”

শুভ্রাংশু এবং সিপিএম-বিজেপি সকলেই অবশ্য সোমবারের বিক্ষোভের পিছনে তাঁদের ভূমিকা অস্বীকার করেছেন। শুভ্রাংশু যেমন বলছেন, “আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। আমি কারও সঙ্গে কোনও বৈঠক করিনি। রবিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কী করেছি, তা আমার এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা এবং দলীয় কর্মীরা জানেন। তা ছাড়া, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দেখলেও বোঝা যাবে, আমি ওই দিন কোথায়, কখন ছিলাম।” রবিবার সকালে তিনি মধ্যমগ্রামে জেলা তৃণমূল দফতরে পুরভোট নিয়ে বৈঠকে ছিলেন। আর বিকেল থেকে রাত সওয়া ১০টা পর্যন্ত ৯, ১৩ এবং ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলেন বলে শুভ্রাংশু জানিয়েছেন।

বিক্ষোভের সঙ্গে তাঁদের যোগ অস্বীকার করে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও দাবি করেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের জন্যই গোটা ঘটনায় রাজনীতির রং লেগেছে। প্রায় একই সুরে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও বলেছেন, “রানাঘাটের ঘটনায় তৃণমূল নিজেদের পাপ বিজেপি-র কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করছে। আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ছি, দুষ্কৃতী দলের এক জনও বিজেপি-র লোক, প্রমাণ করে দেখান!”

বিরোধীদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর রানাঘাট যাওয়ার কথা ঘোষণা হয়েছিল তিনি নবান্ন থেকে রওনা দেওয়ার সামান্য আগে। যে কর্মসূচি আগাম পরিকল্পিতই নয়, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পরিকল্পনা আগে থেকে হবে কী ভাবে? আর স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া অত অল্প সময়ের মধ্যে বিক্ষোভে লোকই বা জমবে কী করে? জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের পাল্টা দাবি, তাঁদের দলকে বিপাকে ফেলাই বিরোধী এবং বিক্ষুব্ধদের উদ্দেশ্য ছিল। মুখ্যমন্ত্রীকে হাতের কাছে পেয়ে গিয়ে তাদের সুবিধা হয়ে গিয়েছে!


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

রানাঘাট নিয়ে তৃণমূল-বিরোধী চাপানউতোর এ দিন পৌঁছেছে সংসদেও। লোকসভার জিরো আওয়ারে তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায় বলেন, “কেন্দ্রের শাসক দলের কারণে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।” তাঁর দাবি, সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাট বা হরিয়ানার হিসারে খ্রিস্টানদের উপরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া আবার পাল্টা নিশানা করেন মুখ্যমন্ত্রীকে। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর হাতে স্বরাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য দফতর রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে যখনই কোনও মহিলার উপরে অত্যাচার হয়, মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যস্ত থাকেন!” অহলুওয়ালিয়ার ওই বক্তব্য শুনে হইচই শুরু করে গোটা তৃণমূল শিবির। সৌগতবাবুর যুক্তি খণ্ডন করে কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী বলেন, “সিসিটিভির ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও চার দিন পরে অপরাধীদের ধরতে ব্যর্থ পুলিশ। এটা সরকারের অপদার্থতা।” সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেন, “কোনও রাজ্যে মহিলা ও সংখ্যালঘু শ্রেণির উপরে অত্যাচার হলে কেন্দ্রের উচিত রাজ্য সরকারের কাছে জবাব চাওয়া। কারণ, এ ধরনের ঘটনায় কেন্দ্র নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।” বেশ কিছু দিন পরে আজ ফের সংসদে রণং দেহি ভূমিকায় দেখা যায় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যাঁকে থামাতে সক্রিয় হন সৌগতবাবু।

পরিস্থিতি দেখে স্পিকার সুমিত্রা মহাজনকে এক সময় বলতে হয়, “আমি ভেবেছিলাম, আপনারা সংবেদনশীল। কিন্তু দেখে তা মনে হচ্ছে না! এটা অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের সময় নয়।” তাতে পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি। শেষ পর্যন্ত স্পিকার এমনও বলেন, “মহিলাদের বিষয় উঠলেই আপনারা যে ভাবে রাজনীতি করতে শুরু করেন, তা ভাল কথা নয়!”

(তথ্য সহায়তা: নয়াদিল্লি ও কলকাতা ব্যুরো)

sushmit halder ranaghat convent nun gang rape case mother superior
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy