ফি-বছর ভাঙন পদ্মায়। —নিজস্ব চিত্র
চৈত্রের বিকেলে পদ্মার পার দিয়ে হুহু বইছে বাতাস। সারা দিন মাঠে কাজ সেরে কামালউদ্দিন মাথায় করে ঘাসের বোঝাটা নিয়ে এসে ধপাস করে ফেলে দিল বিএসএফ ক্যাম্পের সামনে। তার পরে নিজের খাতাটা খুঁজে বার করে বিএসএফের কাছে খাতায় টিপছাপ দিয়েই ফের ঘাসের বোঝা নিয়ে পদ্মা পার ধরে হাঁটতে থাকে। মাঝ পথেই দেখা কুতুবুলের সঙ্গে।
—তা চাচা আজ সন্ধ্যার আগেই চলে এলে যে!
কামালউদ্দিন বলছেন, ‘‘কাল হোলি তো, বাচ্চা দুটো রঙের জন্য বড্ড জেদ ধরেছে, বাজার থেকে একটু রং এনে দিতে হবে তাই।’’
শুনেই বেশ রসিকতা করে কুতুবুল বলছেন, ‘‘কি রঙ নেবে ভাবছ!’’
শুনে গলায় এক রাশ হতাশা নিয়ে কামালউদ্দিন বলেন, ‘‘আর রঙ, রঙের কথা বলো না বাপু, সব রঙই এক। রঙ দেখে আর কি হবে বলতে পার, সেই তো বর্ষা এলে পদ্মাপারে রাত জাগতে হবে।’’
বর্ষার সময় চরলবণগোলায় রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমানো কঠিন। কামালউদ্দিন, কুতুবুলরা তা হাড়ে হাড়ে জানেন। বর্ষা আসলেই মাঝে মাঝে মাঝ নদী থেকে মাঝিরা হাঁক পাড়তে থাকে। নদী জাগছে গোও ও।
ঘুম থেকে উঠে রাত জাগতে শুরু করে চরলবণগোলা। এই বুঝি পদ্মা ঘরবাড়ি গোয়ালঘর সব গিলল।
ভগবানগোলা এক নম্বর ব্লকের হনুমন্ত নগরের পঞ্চায়েতের পদ্মার শাখা নদীর পাড়ে এক ফালি গ্রাম। দুটো পাড়ায় প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের বসবাস। হাই মাদ্রাসা, হাই স্কুল প্রাইমারি স্কুল আছে। বিদ্যুৎয়ের ব্যাবস্থাও আছে বটে তবে নেই পাকা রাস্তা আর স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তবে আরএকটা জিনিস আছে বটে, তা হল প্রতি বছর বর্ষায় পদ্মার ভাঙন। যার কারনে ফি বছরই ঘরবাড়ি, সাজানো বাগান, গরুর গোয়াল ঘর সবই যায় পদ্মার গর্ভে।
তবে ভোট শুরু হলেই পদ্মার পার বেয়ে চরলবণগোলায় একে একে পা পরে রাজনৈতিক নেতাদের তারপই চলে প্রতিশ্রুতির বন্যা। এ বার জিতলেই গোটা পার পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হবে যাদের ঘরবাড়ি গিয়েছে তাদের ক্ষতিপুরণও দেওয়া হবে। তার পর ভোট পার হলেই পদ্মায় হারনো বাড়িঘরের মতোই হরিয়ে যান তারা।
তারপর পাথর দিয়ে পার বাঁধানো তো দুরস্থ এটা বালির বস্তাও পড়েনা। গত বছর বর্ষায়ও দুটি বাড়ি-সহ একটি কলাবাগন, বাঁশ বাগান, গরুর গেয়াল সব গিয়েছে ভাঙনের কবলে। দুপুর বেলায় রান্না ঘরে রান্না করছিলেন লালবানু বিবি অল্পের জন্য তিনি রক্ষা পেলেও তার রান্নাঘর আর ছাগল চলে গিয়েছে নদীর গর্ভে। চরলবণগোলায় ভোটের হাওয়া কেমন?
সেই কথা বলতেই হাতের লাঠিটা নিয়ে সোলেমান শেখ বলছেন, ‘‘ওই দুরে ঝোপের মত জায়গাটা দেখছেন ওই খানে বাড়ি ছিল। সরতে সরতে আজ এই বিএসএফ ক্যাম্পের কাছে এসে ঠেকেছি। তা হলে এবার বুঝুন। আমাদের কথা ভাবার জন্য কেউ নেই বুঝলেন।’’
আজও সে দিনের কথা মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন দিলরুবা বিবি। রাত্রে নিজের ঘরে বাচ্চা দের নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি তারপর হঠাৎই তার বাড়ির অর্ধেকটাই ভাঙনে ধসে পড়ে অল্পের জন্য বাচ্চা নিয়ে রক্ষা পান।
সোলেমান বলেন, ‘‘ভোট আছে ভোটের মতো, নদী নদীর মতো, আর আমরা আমাদের মতো...।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy