Advertisement
০৪ মে ২০২৪

যে সব স্কুলের ‘রান্নাঘরে’ মধ্যমেধায় তারা ফোটে

ওঁরা রাঁধেন আবার চুলও বাঁধেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তাই অনায়াসে নাচ-গান-ছবি আঁকা, এমনকী খেলাধুলোও— স্কুল কর্তৃপক্ষের ভাষায় ছাত্রছাত্রীদের ‘ভাল’ রাখতে না পারলে ভাল ফলটা তাদের কাছ থেকে পাব কী করে? সেই খোলামেলা পরিবেশেই তাদের ‘বিশেষ’ তালিমও চলে।

হোলি ফ্যামিলি গার্লস হাইস্কুল, নবদ্বীপ বকুলতলা উচ্চ বিদ্যালয়

হোলি ফ্যামিলি গার্লস হাইস্কুল, নবদ্বীপ বকুলতলা উচ্চ বিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০১:০৮
Share: Save:

ওঁরা রাঁধেন আবার চুলও বাঁধেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তাই অনায়াসে নাচ-গান-ছবি আঁকা, এমনকী খেলাধুলোও— স্কুল কর্তৃপক্ষের ভাষায় ছাত্রছাত্রীদের ‘ভাল’ রাখতে না পারলে ভাল ফলটা তাদের কাছ থেকে পাব কী করে? সেই খোলামেলা পরিবেশেই তাদের ‘বিশেষ’ তালিমও চলে। বছরের পর বছর তাই, জেলার আর পাঁচটা স্কুলের তুলনায় তারা ‘বিশেষ’ ফলও পায়।

যেমন, কৃষ্ণনগরের হোলি ফ্যামিলি গার্লস হাইস্কুল। পিছিয়ে থাকা মেয়েদের বাছাই করে তাদের সমস্যাগুলিকে আগে চিহ্নিত করাই সেখানে শিক্ষকদের মূল কাজ। তার পর চলে সেই বিষয়ে ‘ভয়’ ভাঙানো। সেই মত তাদের পরবর্তী ‘গাইড’ করা। আর তাতেই প্রতি বছর ভাল ফল করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে হোলি স্কুলটি। শিক্ষিকাদের দাবি, ‘‘ভাল মেয়েরা তো আসবেই। জানতে চাইবেই। আমরাও তাদের উজাড় করে দেব। কিন্তু পিছিয়ে পড়া মেয়েরাই তো আসল চ্যালেঞ্জ।’’ যদিও তা মোটেও সহজ নয়। কারণ ভর্তির জন্য পরীক্ষা নেওয়া হলে অন্তত ৫০ শতাংশ আসনে পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু ছাত্রীদের অগ্রাধিকার দিতে হয়। তার উপরে জেলার স্কুল ছুট মেয়েদেরকেও ভর্তি নিতে হয় এই স্কুলে। হস্টেলে রেখে তাদের তৈরি করতে হয়। স্কুলটি ‘সিস্টারস অফ চ্যারিটি’ সঙ্ঘ দ্বারা পরিচালিত। ১৮৬০ সালে ইটালি থেকে একদল স্বেচ্ছাসেবিকা সিস্টার কলকাতায় আসে‌ন। সেখান থেকে কৃষ্ণনগরে। ওই বছরই ১৭ মার্চ কৃষ্ণনগর ক্যাথেড্রাল গির্জার কাছে তারা একটা ছোট্ট প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরে ধাপে ধাপে এই স্কুল পূর্ণাঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক হয়। এ বার এই স্কুলের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে মধুশ্রী মিত্র। তার প্রাপ্ত নম্বর ৪৮০। পরীক্ষা দিয়েছিল ১৩০ জন। উত্তীর্ণ হয়েছে ১৩০ জনই। ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে ১২১ জন। অন্যান্য বছরগুলিতেও একই রকম ফল করে আসছে স্কুলের ছাত্রীরা। একাধিক বার তারা মেধা তালিকায় দশ জনের মধ্যে থেকেছে। আগামী দিনেও তাদের ছাত্রীরা এই সাফল্য এনে দেবেন বলে মনে করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্কুল‌ের প্রধান শিক্ষিকা সিস্টার এনসিটা বলেন, ‘‘শিক্ষিকাদের পরিশ্রম, আন্তরিকতা আর তাদের বোঝাপড়াই এই সাফল্যের প্রধান কারণ।’’

পিছিয়ে নেই, নবদ্বীপ বকুলতলা উচ্চ বিদ্যালয়। এ বারেও উচ্চ মাধ্যমিকে নিজেদের সুনাম ধরে রেখেছে তারা। ১১৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১১৬ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। সর্বোচ্চ ৪৭৮ পেয়েছে প্রমিত মুখোপাধ্যায়। ৪৬৬ নম্বর পেয়ে সৌম্যজিত কর্মকার দ্বিতীয় স্থানে এবং ৪৬১ পেয়ে বিশাল দেবনাথ স্কুলের মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ৪০০ উপর পেয়েছে ২৫ জন। ৩৮ জন স্টার। ৮৮ জন প্রথম বিভাগে পাশ করেছে।

১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বকুলতলা উচ্চ বিদ্যালয়। শুরু থেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯২৯ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হয়েং স্কুলের ছাত্র ভবপতি মিত্র। সেই শুরু। তারপর থেকে স্কুলের শেষ পরীক্ষার মেধা তালিকায় বকুলতলার কেউ না কেউ থাকবেই। ধারাবাহিক ভাবে ভালো ফলের জন্য বকুলতলার সুনাম এ বারেও অক্ষুন্ন রেখেছে স্কুলের ছেলেরা। ভাল ফল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রতিম প্রামাণিক বলেন, “আজ সবার আগে ওদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। কেননা ছাত্ররা নিজেরা সচেতন না হলে কোন চেষ্টাই কাজে আসে না। আজ তাই সব কৃতিত্ব ওদের প্রাপ্য।” পার্থপ্রতিমবাবু জানিয়েছেন, নিয়মিত ক্লাস করা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার দিকে আমরা খুব জোর দিই। পাশাপাশি স্কুলের নিজস্ব পরীক্ষার প্রশ্ন একটু অন্যরকম ভাবে তৈরি করা হয়। যাতে ছাত্ররা একটু জটিল প্রশ্নোত্তোরের অভ্যস্ত হতে পারে। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে একটা অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের স্কুলের দীর্ঘ দিনের বৈশিষ্ট্য। এবং টেস্টের পর বিশেষ কোচিং ক্লাসে ছাত্রদের আলাদা ভাবে গাইড করা হয়।’’


ধুবুলিয়া দেশবন্ধু হাইস্কুল, বেথুয়াডহরি জেসিএম হাইস্কুল

এ বারেও জেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করেছে স্কুলের পড়ুয়ারা। ২৭১ জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই পাশ করেছে। এ বারে মাধ্যমিকে স্কুলের ছাত্র নিবিড় বিশ্বাস সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। প্রাপ্ত নম্বর ৬৪৬। উচ্চ মাধ্যমিকেও ২৭৮ জনের মধ্যে ২৭০ জন পাশ করেছে। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে অভিজ্ঞান চন্দ্র। তার প্রাপ্ত নম্বর ৪৭১। এ বারে এই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে ১২২ জন স্টার পেয়েছে। এর আগে উচ্চমাধ্যমিকে সর্বোচ্চ ৬৫ জন স্টার পায়। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সত্যরায় বর্ধন বলেন, “নিয়মিত ক্লাস হয়। তা ছাড়া ছাত্রছাত্রীরা যাতে ক্লাসমুখি হয় সে বিষয়ে কড়া নজরদারি রাখা হয়। শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিষ্ঠার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। যার জন্যই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা বরাবরই ভাল ফল করে আসছে।”

দেশভাগের পরে হয়েছিল ধুবুলিয়া দেশবন্ধু হাইস্কুল। সে সময় ধুবুলিয়ায় একটি বড় কলোনি গড়ে ওঠে। এই সব উদ্বাস্তুদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার জন্য তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ১৯৫৩ সালের ২ জানুয়ারি স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়। তখন পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ানো হত। ১৯৫৫ সালে পূর্ণাঙ্গ স্কুল ফাইনাল এবং ১৯৬১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে স্কুলে ভাল ফল করতে শুরু করে। এ বারে স্কুল থেকে ২৭১ জন মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় তার মধ্যে ২৬৬ জন পাশ করেছে। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে ভার্গব মজুমদার। তার প্রাপ্ত নম্বর ৬৩৪। এ বারে স্কুল থেকে ৩৭১ জন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। তার মধ্যে ৩৬২ জন পাশ করেছে। সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে তন্দ্রা ভট্টাচার্য। তার প্রাপ্ত নম্বর ৪৫৬। এই স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিকে ৬০ জনের ওপরে ৮০ শতাংশের নম্বর পেয়েছে।

ধুবুলিয়া দেশবন্ধু হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হায়দর আলি বিশ্বাস বলেন, “নিয়মিত ক্লাস নেওয়া হয়। শিক্ষকেরাও নিজেদের সবটা উজাড় করে দেন। তাতেই এই সাফল্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE