নিজস্ব চিত্র
টেলিস্কোপে চোখ রেখে অবাক তুলসী। এতদিন সে যে চাঁদ দেখেছে তা নিটোল, উজ্জ্বল, সুন্দর। কিন্তু এখন কী দেখছে সে! চাঁদের সারা গা জুড়ে ছোটবড় গর্ত। দেখতে তা মোটেও সুন্দর নয়। কৌতুহল চাপতে না পেরে প্রশ্নটা সে করেই ফেলে, “স্যার, চাঁদের ভেতরটা এত ভাঙা ভাঙা কেন?”
উত্তর অবশ্য পেয়েছিল চতুর্থ শ্রেণির তুলসী দাস। উত্তর পেয়েছিল তার মতো আরও অনেকে। পঠন মেলায় এসে পড়ুয়াদের প্রাপ্তির ঝুলি তাই বেশ ভারী।
আনুষ্ঠানিক ভাবে বুধবার ছিল পঠন মেলা। তাই রাত ১১টা পর্যন্ত স্কুল খুলে রেখে ছাত্রছাত্রীদের মহাকাশের পাঠ দিল রঘুনাথগঞ্জের রাজানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের ছাদে বসানো হয়েছিল টেলিস্কোপ। তাতে চোখ লাগিয়ে কেউ দেখল চাঁদ, কেউ ধ্রুবতারা, কেউ চিনল লুব্ধককে। কেউ বা কালপুরুষের কোমরবন্ধনী দেখে হাততালি দিয়ে উঠল।
কৌতুহলী পড়ুয়াদের নানা জিজ্ঞাসার জবাব দিতে স্কুলে এ দিন আমন্ত্রণ জানানো হয় বিজ্ঞান শিক্ষামঞ্চের রাজ্য কর্তা দক্ষিণ ২৪ পরগণার রবীন্দ্রনগর বিদ্যায়তনের অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক মিলন গাইনকে। তিনি একে এতে পড়ুয়াদের প্রশ্নের জবাব দেন।
গ্রামের বাসিন্দা অখিল দাস এক সময় ছিলেন এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক। মহাকাশ দর্শনের কৌতুহলে সামিল তিনিও। বলছেন, “আমাদেরকেও মাস্টারমশাইরা আকাশ চিনিয়েছিলেন। তবে খালি চোখে। টেলিস্কোপে মহাকাশে চোখ মেলার সুযোগ পাইনি কখনও।”
স্কুলে মহাকাশ দেখতে এ দিন শুধু স্কুলের শিশুরাই নয়, ভেঙে পড়েছিলেন গ্রামের বহু মানুষও। লেসার টর্চ দিয়ে তাঁদের ধরে ধরে চেনানো হল বইতে পড়া চাঁদ, তারা, সূর্যকে। যা দেখে অভিভূত চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র অসীম দাস বলছে, “আকাশে যেন তারার মেলা। লুব্ধক থেকে ঠিকরে পড়ছে আলোর ছটা।”
মহাকাশ দেখানো হবে বলে ভর দুপুরেই ভিড় উপচে পড়েছিল স্কুলে। সূর্য যখন মাঝ আকাশ থেকে পশ্চিমগামী ঠিক তখনই বাটি ভর্তি জলের মধ্যে নির্দিষ্ট কোণে আয়না রাখতেই স্কুলের সাদা দেওয়ালে প্রতিফলিত হয়ে আছড়ে পড়ে আলো। স্পষ্ট ভেসে উঠল বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ লাল ও কমলার আভা। আনন্দে নেচে ওঠে গোটা স্কুল। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী স্বাগতা দাসের কথায়, “সূর্যের হলুদ আলোর মধ্যে এ ভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে সাত সাতটা রঙ কখনও কেউ বলেনি তো! আজ নিজের চোখে দেখলাম।”
টেলিস্কোপ ততক্ষণে ঘুরে গেছে কালপুরুষের দিকে। পূর্ব থেকে দক্ষিণ পূর্ব হয়ে মাঝ রাতে কালপুরুষ হেলে যাবে দক্ষিণ পশ্চিমে। টেলিস্কোপে চোখ রাখতে তখন হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে ছাদে। লেজারের আলো ফেলে তখন রীতিমতো মহাকাশ নিয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে সেখানে।
একে একে নাম বললেন নক্ষত্রদের। বানররাজা (রিজেল), বেলাট্রিকস, আব্রানক্ষত্র, সইফ। কোমরবন্ধনীতে এসে থমকে দাঁড়িয়ে চেনালেন অ্যালনিটাক, অ্যালনিলাম, মিনটাকা। কোমরবন্ধনী ছাড়িয়ে একটু দূরে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটিকে সহজেই চেনা যায় লুব্ধক বলে। ততক্ষণে আকাশ জুড়ে নেমেছে কুয়াশা। ঝাপসা দেখা যাচ্ছে উত্তরের ধ্রুবতারাকে। কুয়াশা সরতেই ফের টেলিস্কোপ হাতে ছাদে। ওই যে দেখ উত্তর আকাশে ডব্লিউ আকারে ক্যাসিওপিয়া। হুমড়ি খেয়ে পড়ল কয়েক জোড়া চোখ। মিলনবাবু জানালেন, চাঁদের বুকে উল্কা খসে পড়ে পড়েই এই ক্ষত বিক্ষত দশা। ছোটবড় গর্ত হয়ে গিয়েছে। দূর থেকে সেগুলিই কালো দেখায়।
পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল “স্যার, কৃত্তিকা নক্ষত্র কোনটা।”
টেলিস্কোপ ঘুরে গেল পূবের আকাশে। “ওই যে পূব দিক থেকে ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে পশ্চিমে সেটাই কৃত্তিকা।”
মিলনবাবু বলছেন, “স্কুলগুলিতে মহাকাশকে চেনাবার ব্যবস্থা থাকা জরুরি।’’ স্কুলের প্রধান শিক্ষক অম্বুজা রাহা বলছেন, “মহাকাশ বিজ্ঞান স্রেফ পাঠ্য বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে বেরোতে পারলে পড়ুয়াদের পাঠগ্রহণ আরও মজাদার হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy