উন্মত্তদের চক্রব্যুহে। ফাইল চিত্র
টানা ৩ ঘণ্টা ধরে মারধর চলেছে। পরিত্যক্ত ট্রাক্টরের সঙ্গে মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা মহিলাকে মারতে-মারতে হেসে গড়িয়ে গিয়েছে আমুদে জনতা। সেই সব ছবি স্পষ্ট দেখা গিয়েছে নানা দিক থেকে মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ছবি, ভিডিও-য়। পরনে শাড়ি নেই, শুধু সায়া-ব্লাউজ। মার খেতে-খেতে মহিলার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। ফেসবুকে এই ছবি দেখে শিউরে উঠছেন রাজ্যের মানুষ।
মুর্শিদাবাদের সেকেন্দ্রায় তিন ঘণ্টা গণপ্রহার চলার পরে পুলিশ যখন নড়ে বসে উতেরা বিবি নামে মানসিক ভারসাম্যহীন বছর চল্লিশের মহিলাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়, তখন তাঁর জীবনী-শক্তি অবশিষ্ট নেই। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি মারা যান।
এই নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পরে খুনের মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার তাদের জঙ্গিপুর আদালতে তোলা হলে এদের তিন জনকে দু’দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাকি সাত জনকে ১৪ দিনের জন্য জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।
বাকিরা কোথায়? নানা ছবিতে যে এত লোককে দেখা যাচ্ছে, তাদের পুলিশ ধরছে না কেন? রঘুনাথগঞ্জ থানার দাবি, সব ছবি-ভিডিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু ঘটনায় জড়িতদের অনেকেই পালিয়েছে। তাদের ধরতে বৃহস্পতিবারও তল্লাশি চালানো হয়।
ইদে পানানগরে বাপের বাড়িতে এসে সোমবার মাঝরাতে বেরিয়ে ছিলেন উতেরা বিবি। মাইল দুয়েক দূরে সেকেন্দ্রায় দিলীপ ঘোষের বাড়ির বারান্দায় তাঁর মেয়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। পরের দিন ভোরে তাঁকে মেয়ে পাচারকারী বলে ধরে পেটানো শুরু হয়। গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প আছে, ফাঁড়িও কাছেই। তবু টানা তিন ঘণ্টা মারধর চলে।
এই ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি দেখছে সব দলই। আজ, শুক্রবার সন্ধ্যায় রঘুনাথগঞ্জ শহরে দলমত নির্বিশেষে প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে। রঘুনাথগঞ্জের ব্লক কংগ্রেস সভাপতি হাসানুজ্জামান বাপ্পা বলেন, “জঘন্যতম ঘটনা। তিন ঘণ্টা নির্যাতন চলল, অথচ পুলিশ সময় মতো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ।” সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সোমনাথ সিংহ রায়ের মতে, “এই মৃত্যু আতঙ্কের। পুলিশের উপরে বিশ্বাসহীনতা বাড়ছে থেকেই মানুষের আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।” তৃণমূলের মহকুমা সভাপতি বিকাশ নন্দ বলেন, ‘‘পুলিশ-প্রশাসনের কাছে দোষীদের গ্রেফতার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।’’
ঘটনার পরে তিন দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ অনেককেই এখনও ধরতে পারেনি। রঘুনাথগঞ্জ থানার আই সি সৈকত রায় অবশ্য বলছেন, “গণপিটুনির হাত থেকে মহিলাকে বাঁচাতে পুলিশ যথাসাধ্য করেছে। কিন্তু কয়েকশো মানুষ বাধা দিয়েছে। কাউকেই ছাড়া হবে না।”
এই তিন দিনে উতেরার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতেও যাননি কোনও নেতা বা প্রশাসনের কর্তা। এ দিন তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাবা সামাদ সেখ ও মা বাদেনুর। সামাদের আক্ষেপ, “আমরা কেমন ভাবে বেঁচে আছি সেটা দেখতে আসার সময়টুকুও কারও হল না?” কাতর গলায় বাদেনুর বলেন, “রাতে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে বারবার মেয়েকে আটকানোর চেষ্টা করেছি। পারিনি। সায়া-ব্লাউজ পরা একটা মেয়েকে দেখেও কেউ বুঝল না যে ও সুস্থ নয়? এ ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলল ?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy