Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
একশো হাতড়ে একসা

চলল পাঁচশোর নোট, বাকি ধারে

কথা ছিল, আর কেউ না নিক, রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টার বা সরকারি বাস পাঁচশো-হাজারের নোট নেবে। নিয়েছে।

ভাঙানি নেই! পাঁচশোর ধাক্কা সামলাতে সামলাতে নাজেহাল পাম্প-কর্মী। কৃষ্ণনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

ভাঙানি নেই! পাঁচশোর ধাক্কা সামলাতে সামলাতে নাজেহাল পাম্প-কর্মী। কৃষ্ণনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৬ ০২:২২
Share: Save:

কথা ছিল, আর কেউ না নিক, রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টার বা সরকারি বাস পাঁচশো-হাজারের নোট নেবে। নিয়েছে।

কথা ছিল, পেট্রোল পাম্পে তেল ভরিয়ে ‘বাতিল’ নোট দিলে তারাও নিয়ে নেবে। নিয়েছে।

কথা ছিল, হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান ফেরাবে না রোগীদের, তামাদি হয়ে যাওয়া নোট নেবে। তারাও নিয়েছে।

কিন্তু ভাঙাতে রাজি হয়নি কেউ। বুধবার সকালের দিকে যা-ও বা একটু-আধটু ভাঙানি মিলেছে, বেলা বাড়তেই ‘নেই-নেই’। হয় একশোর নোট দাও, নয় বাড়ি যাও! একটাই কথা— ‘এত ভাঙানি পাব কোথায়? সবাই তো বড় নোট নিয়ে আসছে!’

রেল সূত্রের খবর, কৃষ্ণনগর স্টেশনে ছ’টি কাউন্টারের জন্য দিনে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা খুচরো দেওয়া হয়। এককটু বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেই খুচরো টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। মুখচেনা দেখে কিছু পাম্প বা ওষুধের দোকান পাঁচশোর নোট জমা নিয়েছে, বাকিটা পরে ফেরত দেওয়া হবে জানিয়ে। ইলেকট্রিক ও টেলিফোন বিল জমা দিতে না পেরে অনেকেই রাগে ফেটে পড়েছেন।

বেশি বিপদে পড়েছেন যাঁদের বহু লোককে নগদ টাকা দিতে হবে, তাঁরা। সবার আগে কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্যোক্তারা। চাঁদা চাইতে গেলে অনেকেই পাঁচশো-হাজার টাকা এগিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘‘একশো কেটে নে!’’ তার উপরে ঢাকি থেকে সাঙ বয়ে নিয়ে যাওয়ার বেহারা, মণ্ডপশিল্পী থেকে ঢাকি সকলেই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ‘বড় নোট’ নেবেন না।

বাগাডাঙা বারোয়ারির মণ্ডপশিল্পী দেবব্রত মালাকার বলেন, “বারোয়ারি কর্তাদের বলে দিয়েছি, পাঁচশো বা হাজার টাকা নেব না।” কৃষ্ণনগরের অন্যতম বড় পুজো চাষাপাড়া বুড়িমা। আশিটা ঢাক, একশো বিশ বেহারা। ঢাকিদের ন’শো, বেহারাদের ছ’শো টাকা করে দিতে হবে। পুজো কমিটির সম্পাদক গৌতম ঘোষ বলেন, “এত একশো টাকা কোথা থোকে পাব ভেবেই মাথা খরাপ হয়ে যাচ্ছে।”

কিন্তু একশো টাকা কোথায়?

মঙ্গলবার রাতে খবরটা বোমার মতো ফাটতেই উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি শুরু হয়েছিল এটিএমে। সেখানেই বা কত মজুত ছিল? তা ছাড়া, ৪০০ টাকার বোতাম টিপে-টিপে কতই বা তোলা যায়? (৫০০ টিপলেই যদি হুশ করে সবুজ নোট বেরিয়ে আসে!) কিছু লোক হয়তো কিছু টাকা পেয়েছেন, বাকিরা ফক্কা। সকালে কারও-কারও হাতে সম্বল বড় জোর তিন-চারটে একশোর নোট। বাকি সব অচলপত্র!

রানাঘাট হাসপাতালের সামনে সাতসকালে গোটা কয়েক পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন কুপার্স ক্যাম্পের সমীর দাস ও তাঁর ভাই সুব্রত। বোনের সিজার হবে। কিন্তু ওষুধের দোকানে বড় নোট নিচ্ছে না। সকালে কৃষ্ণনগর যাওয়ার বাসের টিকিট কাটতে গিয়ে করিমপুরের বিপ্লব চৌধুরী দেখেন, পাঁচশো টাকার নোট নিচ্ছেন না কান্ডাক্টর। ব্যাগ হাতড়ে পঞ্চাশ টাকা খুঁজে পান, তাই রক্ষে।

জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে বীরভূমের সাঁইথিয়া থেকে কৃষ্ণনগরে হাই স্ট্রিটে আত্মীয় বাড়িতে এসেছেন বৃদ্ধা নমিতা রুজ। সকালে বছর সাতেকের নাতির হাত ধরে বাজারে বেরিয়েছিলেন। সঙ্গে শুধু পাঁচশো-হাজারের নোট। ভাঙাতে না পেরে মুখ ব্যাজার তাঁর। করিমপুরের কাছারিপাড়ায় মামার বাড়িতে থেকে বিজ্ঞান নিয়ে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে ভাস্কর সরকার। এ দিন তার প্রাইভেট টিউশনের ফি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একশো টাকার নোট না পেয়ে আপাতত তা মুলতুবি।

কল্যাণী ‘বি’ ব্লকের শ্যামসুন্দর দাস সকালে বাজারে গিয়ে আড়াইশো টাকার মাছ কিনে পাঁচশোর নোট দিয়েছিলেন। দোকানদার নোট নিলেন। এবং জানিয়ে দিলেন, ফেরত হবে না। বাকি আড়াইশো জমা রাখতে হবে। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। শ্যামবাবু থলে হাতে গুটি-গুটি বাড়ি ফিরলেন।

তবু, সত্যি বলতে ওই ছোট ব্যবসায়ী আর দোকানদার না থাকলে পরিস্থিতি আরও খারপ হত। শিমুরালি বাজারের দোকানি অমল দে বলেন, “দীর্ঘদিন ব্যবসা করছি। সকলেই কমবেশি পরিচতি। পাঁচশোর টাকার নোট নিয়ে কেউ এলে ফেরাতে খারাপ লাগছে। যতক্ষণ সম্ভব নিচ্ছি।” কৃষ্ণনগরের মুদি দোকানি ভোলানাথ ঘোড়াই জানান, তাঁরাও বড় নোট নিচ্ছেন, তবে পুরো টাকার মাল নিতে হবে এই শর্তে।

তবে সব মিলিয়ে ভাল রকম ধাক্কা খেয়েছে দোকান-বাজার। কৃষ্ণনগরে পাত্রবাজারের সব্জি বিক্রেতা সৌমেন নাগ বলেন, “প্রায় ৬০ শতাংশ কম বিক্রি হয়েছে।” মুরগি দোকানি রেবা খাতুন কেজিতে দশ টাকা করে দাম কমিয়ে দিয়েও সামাল দিতে পারেননি। পাত্রবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক গোপাল বিশ্বাস বলেন, “এমন বাজে অবস্থা কোনও দিন দেখিনি।”

ইতিমধ্যেই নানা আনাচে-কানাচে পাঁচশোর নোট নিয়ে তিনটে বা চারটে একশোর নোট দেওয়ার খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। দোকানিরা আর ক’দিন ধার দেবেন? ব্যাঙ্ক দ্রুত টাকার জোগান না দিলে ফড়েরাজই না কায়েম হয়ে যায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

500 rs 500 and 1000 rs banned
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE